গাছটার সামনে থামল ওরা।
রাস্তার ওধারে লাল রঙের একটা ভর্তা হয়ে যাওয়া জিনিস দেখাল মুসা। গাড়ি ছিল ওটা।
সারা ব্লক জুড়ে ধ্বংসলীলা চলেছে। ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। ভর্তা হয়ে যাওয়া গাড়ি। ভেঙে পড়া গাছ। ছেঁড়া তার। রাস্তায় বড় বড় গর্ত। দলিত মথিত পাতাবাহারের বেড়া আর ফুলের বেড।
রাস্তা আটকে রেখেছে তিনটে পুলিশের গাড়ি। নীরবে জ্বলছে নিভছে ওগুলোর লাল আলো।
ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জটলা করছে লোকে। নানা রকম জল্পনা করছে। মাথা চাপড়াচ্ছে কেউ। কেউ বা উত্তেজিত কণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করছে অন্যকে। হাত তুলে দেখাচ্ছে ধসে পড়া বাড়িঘর, ভর্তা হয়ে যাওয়া গাড়ি। চমকে যাওয়া বিমূঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে কেউ কেউ।
এ সবের মূলে আমরা! বিড়বিড় করে বলল মুসা। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না কোনমতেই। লোকের সর্বনাশ করেছি!
আমাদের দোষ বলা যাবে না, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। আমরা তো জানতাম না তাস খেললে এতবড় কাণ্ড ঘটবে। আমাদেরকে দিয়ে যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে, দোষী আসলে সে। মিস লীলা রেডরোজ। তাকে খুঁজে বের করা দরকার।
আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, হতভম্ব হয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল রবিন। গলা কাঁপছে। ভাবতেই পারছি না, সাধারণ কয়েকটা তাস এতবড় ক্ষতি করে দিতে পারে।
কয়েকজন প্রতিবেশীকে ওদের দিকে তাকাতে দেখে কুঁকড়ে গেল মুসা। তার মনে হতে লাগল ওরা যে অপরাধী লোকে সেটা টের পেয়ে গেছে। জেনে গেছে খেলতে বসে নাইট আর ড্রাগন ডেকে এনে ওরা এই মহা সর্বনাশ ঘটিয়েছে।
ভাবনাগুলো কোনমতেই স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না মুসাকে। তাসের প্যাকেটটা বয়ে এনেছে বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। ইস, কোন কুক্ষণে যে কাকু-কাকুর বাড়িতে গিয়েছিল!
ভাবনাগুলো অন্য দুজনেরও শান্তি হারাম করছে। যতই ভাবছে, রাগটা গিয়ে পড়ছে লীলা রেডরোজের ওপর। অঘটনগুলোর জন্যে সত্যিই যে দায়ী।
ওর বাড়ির দিকে হাঁটা দিল আবার তিন গোয়েন্দা। পুলিশের গাড়িগুলো পার হয়ে এল। কানে এল রেডিওর কড়কড় শব্দ। ইউনিফর্ম পরা অফিসারেরা রাস্তার এ মাথা ও মাথায় হাটছে। গভীর ছাপগুলো দেখছে। মাথা চুলকাচ্ছে বোকার মত। বিস্মিত ভাবভঙ্গি।
মোড়ের কাছ থেকেই দেখা গেল লীলা রেডরোজের বাড়িটা। দরজা-জানালা সব বন্ধ। বাড়িতে যে কেউ নেই সেটা বোঝার জন্যে কাছে যাওয়া লাগে না।
বাড়িটায় ঢুকল ওরা। কিশোরের অনুমানই ঠিক। তালা লাগানো। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে লীলা রেডরোজ।
হতাশ হলো মুসা। ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পেরে।
কিশোর বলল, মহিলাকে খুঁজে বের করবই আমরা। জিনিসপত্র যা নষ্ট হয়েছে, সেগুলোর ক্ষতিপূরণ যদি না দিতে পারে, জেলের ভাত খাবে।
রেডরোজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কাকু-কাকুর বাড়ির দিকে এগোল। ওরা। সামনের দরজা বন্ধ। জানালাগুলোর কোনটাতেই প্রাণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার। বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল সকালের খবরের কাগজটা পড়ে রয়েছে ড্রাইভওয়েতে।
ঘটনাটা কি? কাকু-কাকুও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল নাকি?
দেখো, কাকু-কাকুর বাড়িটার কিছুই হয়নি, কিশোর বলল। ওর লন, সামনের আঙিনা, কোথাও কোন ক্ষতি হয়নি।
পকেটের তাসের প্যাকেটটায় হাত রাখল মুসা। বাড়ি থাকলেই হয় এখন। তাসগুলোকে তাড়াতে পারলে বাঁচি।
রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে কাকু-কাকুর সুন্দর করে ছাঁটা লনে প্রবেশ করল ওরা। ওর সামনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
জানালা দিয়ে উঁকি দিল মুসা। কিন্তু রোদের প্রতিফলন জানালার কাছে এক ধরনের সোনালি পর্দা সৃষ্টি করেছে। ভেতরে দৃষ্টি প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।
বড় করে দম নিল সে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে তিন ধাপ নিচু সিঁড়ি বেয়ে সামনের দরজার কাছে উঠে ঘণ্টার বোতাম টিপে ধরল। বাড়ির ভেতর থেকে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ কানে এল।
মিস্টার কাকু-কাকু, বাড়ি আছেন? ডেকে জিজ্ঞেস করল মুসা। ভয় যে পাচ্ছে, সেটা প্রকাশ পেল কণ্ঠস্বরেই। মিস্টার কাকু-কাকু?
জবাব নেই।
বাড়ির ভেতর থেকে পদশব্দ ভেসে এল না। কোন শব্দই নেই।
আবার বেল বাজাল মুসা। অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ করেই হাত দুটো বরফের মত শীতল লাগতে লাগল তার। চাদির কাছে দপদপ করছে মাথার শিরাগুলো।
ভয় তো পাবই, নিজেকে কৈফিয়ত দিল সে। লোকটা জাদুকর। অদ্ভুত, অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তার। হয়তো একজন ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী প্রেতসাধকই, কে জানে।
এবং সেই ক্ষমতাশালী লোকটা ভাবছে, তার জিনিস চুরি করেছে মুসা।
কি, কিছু শুনছ? নিচ থেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। তার কাছ ঘেঁষে এল রবিন। দুজনে তাকিয়ে রয়েছে মুসার দিকে।
আবার বেল বাজাল মুসা। দুই হাতে কিল মারতে শুরু করল দরজায়।
ঠেলা লেগে খুলে গেল দরজা।
ভীষণ চমকে গেল সে। মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি।
অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করে মাথা ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। বাড়ির ভেতরে সামনের অংশটা অন্ধকার। ভারী দম নিল সে। নাকে এল তীক্ষ্ণ, মিষ্টি এক ধরনের সুবাস। মশলা মেশানো।
মিস্টার কাকু-কাকু? ডাক দিল আবার।
অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হলো তার ডাক। ভোতা, ফাপা এক ধরনের শব্দ।
আবার ভারী দম নিল সে। প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকা হৃৎপিণ্ডটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর দরজাটাকে আরেকটু ফাঁক করে পা রাখল ঘরের ভেতর।