কাজ হবে তো?
.
১৪.
ফট করে জোরাল একটা শব্দ হলো। অনেক বড় একটা বৈলুন ফেটে যাওয়ার
তীব্র সাদা আলোর ঝলকানিতে একই সঙ্গে শোনা গেল তিনজনের বিস্মিত চিৎকার।
চোখ মিটমিট করে জানালার দিকে দৃষ্টি ফেরাল কিশোর। সকালের ঝলমলে রোদ বন্যার মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘরে।
বাইরে এখন স্তব্ধ নীরবতা।
জানালার কাছে ছুটে গেল ওরা। বাইরে উঁকি দিল।
ইয়া বড় বড় পায়ের ছাপ পড়ে আছে মাটিতে। গম্ভীর হয়ে দাগ বসে গেছে।
ড্রাগন নেই। কোথাও দেখা গেল না ওটাকে। উধাও হয়ে গেছে।
আনন্দে কথা বেরোল না মুসার মুখ থেকে। নীরবে পিঠ চাপড়ে দিতে লাগল কিশোরের।
হাসতে শুরু করল রবিন। হাসিটা সংক্রামিত হলো মুসার মাঝে। কিশোরও নীরব রইল না আর। পাগলের মত হাসতে লাগল তিনজনে। পিঠ চাপড়ে দিতে তাসের খেলা লাগল পরস্পরের। শেষে কোলাকুলি শুরু করল।
ড্রাগনটা চলে যাওয়ায় হাপ ছেড়ে বেঁচেছে।
কিন্তু টেবিলের ওপর রাখা তাসগুলোর দিকে চোখ পড়তেই হাসি বন্ধ হয়ে গেল মুসার। ওগুলো দিয়ে আসতে হবে কাকু-কাকুকে। এখনই।
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন। এমন করে তাকাতে লাগল তাসগুলোর দিকে, যেন যে কোন মুহূর্তে বোমার মত ফেটে যাবে ওগুলো। কাকু কাকু আগেই সাবধান করে দিয়েছিল আমাদের, তাসগুলো বিপজ্জনক। আমরাই কানে তুলিনি।
মাথার ঘন কোঁকড়া চুলে আঙুল চালাল কিশোর। কাকু-কাকু যদি জানবেই তাসগুলো এতটা বিপজ্জনক, তাহলে বিক্রির জন্যে সাজাল কেন?
ওগুলোর হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল হয়তো, জবাব দিল রবিন।
মিসেস রেডরোজই বা চুরি করল কেন?
অতিরিক্ত দাম হাঁকত কাকু-কাকু। বিনে পয়সায় জোগাড় করা গেলে দাম দিতে যাবে কেন?
তাহলে মুসার পকেটে ভরে পাচার করল কেন?
ধরা পড়লে মুসা পড়ত। চোর হিসেবে তার শাস্তি হত। এটা তো সোজা কথা।
মাথা নাড়ল কিশোর, উঁহু, অত সোজা নয়। নিজের ঠোঁটে জোরে এক টান দিয়ে ছেড়ে দিল। কারণটা অন্যখানে। মিসেস রেডরোজ জানত, তাকে দেখতে পারে না প্রতিবেশীরা। তাড়াতে চায় এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেডরোজ। তবে যাওয়ার আগে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। তাসগুলো মুসার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল প্ল্যান করেই। জানত, তাসগুলো পেলেই খেলতে চাইব আমরা। আর খেলতে বসলে নিজেদের অজান্তেই ভয়ানক ক্ষতি করে দেব পড়শীদের। যদি দোষ পড়ে আমাদের ওপর পড়বে। এক মুহূর্ত ভাবল সে। তারপর বলল, হ্যাঁ, এটাই একমাত্র কারণ। আমি শিওর।
রেগে উঠল মুসা, তাহলে তো মহিলাকে গিয়ে এখনই ধরা দরকার…
পাবে কোথায়? ভুরু নাচাল কিশোর। গিয়ে দেখগে, তার বাড়িতে তালা। মারা।
তুমি দেখেছ নাকি?
না। অনুমান করছি। তাসের খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্যে বসে থাকবে না সে।
তাহলে আর সময় নষ্ট করছি কেন? চলো যাই। আগে মিসেস রেডরোজের বাড়িতেই যাব। ওখান থেকে কাকু-কাকুর বাড়িতে যাব। তাসগুলো ফেরত দিয়ে আসতে।
আমরাও যাব? কাকু-কাকুর বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছে রবিন। সমর্থনের আশায় কিশোরের দিকে তাকাল।
কিশোর কিছু বলার আগেই মুসা বলে উঠল, আমাকে একা পাঠাতে চাও নাকি? আমি বাপু একা যেতে পারব না। তোমরা সঙ্গে থাকলে তা-ও সাহস পাব।
রবিনের দিকে তাকা কিশোর। তারপর মাথা ঝাঁকাল। বেশ। চলো।
তাসের বাক্সটার জন্যে হাত বাড়াল মুসা। যেই তুলে নিতে যাবে মুখটা খুলে গিয়ে একটা তাস পড়ে গেল মাটিতে। ধড়াস করে উঠল তার বুকের ভেতর। আবার না কোন অঘটন ঘটে যায়।
নিচু হয়ে তাড়াতাড়ি তুলে নিল তাসটা।
ওটায় কি আছে দেখে আঁতকে গেল।
দেখো দেখো! চিৎকার করে উঠল সে। এ তাসটা তো আগে দেখিনি একবারও!
অন্য দুজনের দেখার জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দিল সে।
আরে এ তো…এ তো কাকু-কাকুর ছবি! রবিনও হতবাক।
কিশোরও দেখল। ভুল বলেনি মুসা বা রবিন। কাকু-কাকুই। সাদা চুল। সাদা গোফ। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠেলে বেরিয়ে আছে ঠোঁটের দুই কোণে গোল গোল কুতকুতে নীল চোখ মেলে যেন সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে।
দেখো তো, উল্টো দিকে কিছু আঁকা আছে কিনা? কিশোর বলল।
তাসটা ওল্টাল মুসা। অবাক হয়ে দেখল, লেখা রয়েছে: জাদুকর।
হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। জাদুকর। তারমানে এটা মায়াতাস। সমস্ত তাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু বুঝলে?
জোরে জোরে মাথা নাড়াল মুসা। বোঝাবুঝির আমার দরকার নেই। এগুলোর কোন ব্যাপারেই আর ঢুকতে চাই না। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। চলো; গিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়ে আসি।
কিন্তু তার কথায় কান দিল না কিশোর। তাসটা হাতে নিয়ে উঁচু করে দেখল। আনমনে বিড়বিড় করল, সত্যিই কি জাদুকর? জাদু বলে সত্যি কোন জিনিস আছে?
তাসটা আবার কেড়ে নিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পকেটে ভরে ফেলল মুসা, না থাকলে খানিক আগে কার ভয়ে ঘাম ছুটে গেল আমাদের? ড্রাগনের পায়ের ছাপ তো এখনও রয়েছে মাটিতে। এগুলো কি মিথ্যে? দেখো, অত কথার দরকার নেই। চলো, ফেরত দিয়ে আসি…
কিন্তু রহস্যটা ভেদ না করেই?
কিশোরের কোন কথার ধার দিয়েই গেল নাঃআর মুসা। তার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে।
জিনসের প্যান্টের পেছনের পকেটে ভরে নিয়েছে তাসের প্যাকেটটা।
.
১৫.
সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তিনজনে। সামনের লনের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।
মোড়ের কাছে বিশাল একটা ম্যাপল গাছ ছিল। কাত হয়ে পড়ে আছে এখন বিদ্যুতের তারের ওপর। একনাগাড়ে ফুলিঙ্গ ছিটাচ্ছে এখন ছেঁড়া তারগুলো। মাঝে মাঝে বেড়ে গিয়ে ফুলিঙ্গের ফুলঝুরি তৈরি করছে। চড়চড়, ছরছর শব্দ। করেই চলেছে।