পাশাগুলো হাতের তালুতে নিয়ে চেপে ধরল মুসা। হাতের তালু খুলে ঝাঁকাল। চোখ বুজল। প্রার্থনা করতে লাগল চারটে ছক্কার জন্যে।
হাতটা নামাল টেবিলের ওপর। আস্তে করে গড়িয়ে দিল পাশাগুলো।
.
১২.
দূর! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
তিনটে এক আর একটা দুই।
আবার চালো! আবার চালো! তাগাদা দিল কিশোর। চেষ্টা করে যাও, মুসা। তিনটে চাল আছে হাতে।
পাশাগুলোর জন্যে হাত বাড়াল মুসা। বাইরে একটা শব্দ থামিয়ে দিল ওকে। টেবিলের কাছ থেকে সরে এসে দৌড় দিল সামনের জানালার দিকে।
খাইছে! বিড়বিড় করে বলল সে। সামনের রাস্তায় মুখোশ পরা পাঁচজন নাইট চোখে পড়ল। একসঙ্গে হাঁটছে। মার্চ করে। ধীরে ধীরে। এক হাতে ধরা বর্মগুলো সামনে বাড়ানো। অন্য হাতের তরোয়াল খাড়া করে ধরে রেখেছে ওপর দিকে।
রোদে চকচক করছে পরনের ধাতব বর্ম। ড্রাগনের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল। গভীর ধূসর ছায়াতে মিশে গেল ওদের বর্ম পরা দেহ।
এ ক’জনকে দিয়ে আর কি হবে, পাশ থেকে বিড়বিড় করল কিশোর। চারটেতেই যদি ছক্কা উঠত, তাহলেও নাহয় একটা কথা ছিল…
কথা শেষ হলো না তার।
তিনজনেই দম আটকে ফেলল। একসঙ্গে দুজন নাইটকে কামড়ে ধরে তুলে নিয়েছে ড্রাগনটা। মাথাটাকে ঝাড়া দিয়ে ছুঁড়ে দিল একপাশে। একটা বাড়ির ছাতের ওপর দিয়ে উড়ে গেল দেহ দুটো।
আবার মুখ নামাল ক্ষিপ্ত জানোয়ারটা। রাগে গর্জন করে মুখ দিয়ে তিনবার আগুন নিক্ষেপ করল বাকি তিনজন নাইটকে লক্ষ্য করে।
আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে তরোয়াল, বর্ম সব ফেলে দিয়ে দৌড় মারল নাইটেরা। নিজেদের গায়ের বর্মের ঝনঝনানিতে ঢাকা পড়ে গেল ওদের চিৎকার।
ড্রাগনটাই জিতছে, বিড়বিড় করে বলল রবিন।
আতঙ্কে জমে গিয়ে দেখল ওরা, ড্রাগনটা এগিয়ে আসছে মুসাদের বাড়ির দিকে। মাথাটা বার বার ঝুঁকি দিয়ে পেছনে টেনে নিচ্ছে আক্রমণের ভঙ্গিতে।
ঢুকে পড়ল ওটা সামনের লনে। বিশাল ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেল বাড়িটা।
সর্বনাশ! এদিকেই তো আসছে! ভয়ে দম আটকে আসছে মুসার। আমাদেরকে ধরতে আসছে!
১৩.
আকাশে ভাসমান মেঘ যেমন সচল ভাবে ছায়া ফেলে ঢেকে দেয়, তেমনি ভাবে মুসাদের বাড়িটাকে ঢেকে দিয়েছে ড্রাগনের ছায়া। হঠাৎ শীত করতে লাগল ওদের। যেন সূর্যের সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়েছে ড্রাগনের ছায়া।
ঘুরে দাঁড়াল মুসা। জোর করে সরে এল জানালার কাছ থেকে।
কাঁপতে কাঁপতে দৌড় দিল রান্নাঘরের দিকে।
সামনের আঙিনায় ড্রাগনের সরীসৃপ সুলভ হিঁচড়ে আসার শব্দ হচ্ছে। প্রতিবার পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠছে বাড়িটা।
একটা গাছ ভাঙার মড়মড় শব্দ কানে এল। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল গাছটা। তার ছিঁড়ে চড়চড় শব্দ করতে লাগল বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ।
বাড়ির পাশ ঘুরে আসছে, চিৎকার করে জানাল রবিন।
শীতল অন্ধকার ছায়া এগিয়ে এসে ঢেকে দিচ্ছে এখন পেছনের আঙিনা। তারপর ছায়াটা পড়ল রান্নাঘরের জানালায়।
চোখ তুলে জানালার দিকে তাকাল মুসা। ড্রাগনের মস্ত, রিঙের মত করে পরানো আঁশওয়ালা, বর্মপরা চেহারার বুকটা দেখতে পেল। বাড়ির পেছনে ধাক্কা খেল ওটার শরীর। থরথর করে কেঁপে উঠল পুরো বাড়িটা। রান্নাঘরের প্লাস্টার ভেঙে খসে গিয়ে ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল।
জানালার কাছে মুখ নামাল ওটা। কানফাটা শব্দ তুলে বন্ধ করল হাঁ করা চোয়াল দুটো। বাস্কেটবলের সমান বড় লাল টকটকে চোখ মেলে উঁকি দিল ঘরের ভেতরে।
চিৎকার দিয়ে জানালার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে শুরু করল রবিন। কিশোরের গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল। থামল না। কিশোরের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল ঘরের অন্য প্রান্তের দিকে।
জানালার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। অন্য কোন দিকে নজর নেই। ঘনঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। আচমকা ছোট্ট একটা চিৎকার দিয়ে ঘুরে দৌড় মারল টেবিলের দিকে। একটা মরিয়া ভাবনা মাথাচাড়া দিয়েছে মনে।
টেবিলটার ওপর প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ল সে। দুহাতে দুদিক থেকে ঝাড় দিয়ে এনে জড় করতে শুরু করল টেবিলে পড়ে থাকা তাসগুলো। থরথর করে কাঁপছে।
সবগুলো তাস একহাতে নিয়ে অন্য হাতে তুলে নিল বাক্সটা।
তাসগুলোকে বাক্সে ঢোকানোর চিন্তা ছাড়া আর কিছু ভাবছে না আপাতত।
ঢোকাতে পারলে হয়তো চলে যাবে ড্রাগনটা।
গত রাতের মত।
গতরাতে, মনে আছে তার, তাসগুলোকে সব একসঙ্গে করে বাক্সে ঢোকাতেই থেমে গিয়েছিল ঝড়বৃষ্টি। আলো ফিরে এসেছিল।
ঝনঝন করে উঠল জানালা। ড্রাগনটার নাকের ছোঁয়া লেগেছে ওখানে। ফিরে তাকাল কিশোর। লাল চোখ দুটো ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নাকের ফুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল দানবটার।
মাথাটাকে পেছনে টেনে নিল ড্রাগন। লম্বা গলাটা ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেল।
আঘাত হানতে যাচ্ছে। মাথা দিয়ে বাড়ি মারবে। প্রচণ্ড আঘাতে গুঁড়িয়ে দেবে ঘরের দেয়াল। তারপর ওদেরকে কামড়ে ধরে টেনে বের করবে।
সময় নেই। একেবারেই সময় নেই।
বাক্সের মধ্যে তাসগুলো ঢোকানো শুরু করল সে।
তাড়াহুড়োয় হাত থেকে পড়ে গেল বাক্সটা।
আপনাআপনি চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
ঝপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কাঁপা হাতে থাবা দিয়ে তুলে নিল আবার বাক্সটা।
তাসগুলো অর্ধেক ঢুকিয়েছিল। ঠেলা দিয়ে বাকিটাও ঢুকিয়ে দিতে লাগল।
ঠেলা! ঠেলা! ঢুকে যাচ্ছে তাসগুলো।
ঢোকা শেষ।
বাক্সের মুখ বন্ধ করে দিল সে।