শব্দ শুনছে, কিন্তু বাড়ির পেছনটা চোখে পড়ছে না বলে কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
ঘুরে সামনের দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা। পেছনে ছুটল কিশোর আর রবিন।
ঠেলা দিয়ে পাল্লাটা খুলে ফেলল মুসা। ভয়ঙ্কর আরেকটা গর্জন শুনতে পেল।
এ রকম শব্দ জীবনে শোনেনি সে।
বাঘ-সিংহের ভারী গলার কর্কশ গর্জন নয়। এমনকি হাতির কানফাটা চিৎকারও নয়।
শব্দটা কেমন বোঝানো খুব কঠিন। এ শব্দটা শুরু হচ্ছে মেঘের চাপা গুড়গুড় ডাকের মত। পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দ্রুত বেড়ে যায়। মাটি কাঁপতে থাকে। বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। ভারী এই গমগমে গর্জনের সঙ্গে মিলিত হয় শিসের মত তীক্ষ্ণ একটানা শব্দ।
মড়মড় শব্দ শোনা গেল। একটা গাছ ভেঙে পড়ল।
মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি বাড়ছে।
মুসাদের সামনের লনে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। দৌড় দিল রাস্তার দিকে। মোড়ের কাছে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল। রাস্তার ওপর মস্ত এক ছায়া পড়েছে।
ড্রাগনটাকে দেখতে পেল মুসা। ছায়ার ওপর সরে আসছে।
টাওয়ারের মত উঁচু। কাটা বসানো। বদমেজাজী। অবিকল তাসের গায়ে আঁকা ছবিটার মত।
আমি…আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! চিৎকার করে উঠল মুসা।
কাঁটা বসানো মেরুদণ্ডটার দুপাশে দুটো রূপালী ডানা। ছড়িয়ে রেখেছে। জাহাজের পালের মত। হাঁটার সময় ওই ডানা লেগে ছিঁড়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের তার। ঝরঝর, ছরছর করে স্ফুলিঙ্গ ছিটাচ্ছে বিদ্যুৎ।
বিশাল মাথাটা কাত করে আবার প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল দানবটা। থপ থপ শব্দ তুলে ঝোলা ভারী দেহটা নিয়ে দুলে দুলে সামনে এগোচ্ছে। ধাক্কা লেগে মাটিতে ভেঙে পড়ছে বিদ্যুতের খুঁটি।
মস্ত একটা পা উঁচু করল ড্রাগনটা। একটা গাড়ির ওপর ফেলল। দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মত চ্যাপ্টা হয়ে গেল গাড়িটা।
লোকে চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। বাচ্চারা কাঁদছে। চেঁচাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ হারাল একটা গাড়ি। চাকার আর্তনাদ আর ইঞ্জিনের গর্জন তুলে এলোপাতাড়ি ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল একটা বাড়ির লনে।
মুসার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ করে ড্রাগনটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সিনেমা হলে গডজিলার ছবি দেখছে। যেন। বিড়বিড় করে বলল, ড্রাগন…একটা সত্যিকারের ড্রাগন!
আমরা ওটাকে এখানে নিয়ে এসেছি, কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। ওটাকে সরানোও আমাদেরই দায়িত্ব। কিছু একটা করা দরকার। জলদি।
ঘুরে তাকাল রবিন। চোখেমুখে আতঙ্ক। করা তো দরকার। কিন্তু কি?
ইয়ে…
মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠল কিশোর, এক কাজ করা যায়।
আবার গর্জন করে উঠে আরেকটা গাড়ি পায়ের নিচে ফেলে ভর্তা করল ড্রাগন।
জলদি… তাগাদা দিল কিশোর। বাড়ির ভেতরে চলো। লন ধরে দৌড়ানো শুরু করল সে।
শেষবারের মত ড্রাগনটার দিকে তাকাল আরেকবার মুসা। নাক দিয়ে আগুন বের করছে তখন ওটা। তারপর দৌড় দিল কিশোর আর রবিনের পেছন পেছন। দৌড়াতে দৌড়াতেই জিজ্ঞেস করল, তোমার উদ্দেশ্যটা কি?
রান্নাঘরে ঢোকার আগে আর জবাব দিল না কিশোর। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তাস! ড্রাগন আঁকা তাসটা দরকার। ওটাকে বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হয়তো ড্রাগনটাও চলে যাবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ! একমত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ঠিকই বলেছ। কাল রাতের কথা মনে আছে? তাসটা বাক্সে রাখতেই ঝড়-বৃষ্টি সব থেমে গেল।
জানি না কি ঘটবে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর। তবে কাজ হলেও হতে পারে।
বিকট শব্দে আছড়ে পড়ল কি যেন। চমকে গেল তিনজনেই। আরেকটা গাছ পড়ল নাকি? এত কাছে! যেন ওদের জানালাটার বাইরেই।
কোথায় ওটা? চিৎকার করে উঠল মুসা। ড্রাগনের তাসটা কোনখানে?
চিত করে রেখেছিলাম আমি ওটা, রবিন বলল। মনে পড়ে? আমার সামনে টেবিলের ওপর রেখেছি।
খুঁজে না পেয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। এখানে নেই ওটা!
হাল ছাড়ল না মুসা। তাসগুলোর মধ্যে খুঁজতে শুরু করল। বুঝল, কিশোর ঠিকই বলেছে।
ড্রাগনের তাসটা উধাও।
তারমানে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, যাকেই ডেকে আনা হচ্ছে, ফিরে যাবার সময় মুক্ত হয়ে যাচ্ছে ওটা। তাতেই সম্ভবত উধাও হয়ে যাচ্ছে তাসগুলো, কিশোর বলল।
এখন? এবার কি করা? গুঙিয়ে উঠল রবিন।
বাইরের হট্টগোল বেড়েই চলেছে। সাইরেনের শব্দ ওঠা-নামা করছে। মড়মড় করে কাঠ ভেঙে পড়ার শব্দ হলো।
মেরুদণ্ডে শীতল শিহরণ বয়ে গেল কিশোরের। টেবিলে পড়ে থাকা একটা তাসের দিকে তাকিয়ে থেকে আরেকটা বুদ্ধি এল মাথায়।
মুখোশ পরা নাইট! চেঁচিয়ে উঠল সে।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা আর রবিন।
নাইট দিয়ে কি হবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
খাবলা দিয়ে টেবিল থেকে পাশাগুলো তুলে এনে মুসার দিকে বাড়িয়ে ধরল কিশোর, নাও, চালো। নাইটদের এক বিশাল বাহিনী দরকার আমাদের। রূপকথার গল্পে এ ধরনের সৈন্যরাই লড়াই করে ড্রাগন তাড়াত।
কিন্তু… পাশাগুলোর দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে বলতে গেল মুসা।
ওকে কথা শেষ করতে দিল না কিশোর। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? যত বেশি সম্ভব পয়েন্ট জোগাড় করতে হবে এখন আমাদের। প্রচুর শক্তি দরকার।
সাহস জোগানোর জন্যে মুসার পিঠে চাপড় মারল কিশোর। গুড লাক, মুসা। চালো। সবগুলোতেই ছক্কা তোলো। জলদি!
বাইরে আবার গর্জন। বিদ্যুতের চড়চড়ানি। রাস্তায় আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি।