বেশ। বিড়বিড় করে আরও কি বলল মুসা, বোঝা গেল না। তাসের খেলা
রেফ্রিজারেটর থেকে কমলার রসের বোতল বের করে গ্লাসে ঢেলে নিল সে। ফিরে তাকাল কিশোর আর রবিনের দিকে। এক গেম খেলব আমি। মাত্র একটা গেম। ব্যস। তারপর কিছু ঘটুক বা না ঘটুক, তাসগুলো আমি ফেরত দিয়ে আসব। কাকু-কাকুকে।
তাস শাফল করে টেবিলে উপুড় করে রাখল কিশোর।
একটা তাস টেনে নিতে হাত বাড়াল রবিন। তিনজনেই সামনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে কি ওঠে দেখার জন্যে।
ঘাড়ের পেছনে শিরশির করছে মুসার।
তাস ওল্টানোটা কি ঠিক হচ্ছে? ভুল করছে না তো আবার?
তাস টেনে নিল রবিন।
উল্টে ফেলল।
চিৎকার করে উঠল মুসা।
.
১০.
রবিনের হাতের তাসটায় ড্রাগন আঁকা।
মাথা তুলে রেখেছে ড্রাগনটা। গাঢ় রূপালী রঙ। লম্বা ঘাড়টা বাকা করে রেখেছে আক্রমণের ভঙ্গিতে। পিঠের মেরুদণ্ড বরাবর বড় বড় মারাত্মক কাটা খাড়া হয়ে আছে। প্রচণ্ড রাগে চোখ দুটো জ্বলছে। বুকের আঁশগুলোকে মনে হচ্ছে। ধাতব বর্মের মত। বুঝিয়ে দিচ্ছে যেন কোন বাধাই বাধা নয় ওটার কাছে। আধ ছড়ানো অবস্থায় রয়েছে কাঁধের কাছের ডানা দুটো।
লম্বা কুমিরের মত মুখটা হাঁ করে আছে গর্জনের ভঙ্গিতে। মুখের ভেতরে অসংখ্য ধারাল দাঁতের সারি। নাকের ফুটো দুটো ছড়ানো। কমলা রঙের আগুন বেরোচ্ছে নিঃশ্বাসের সঙ্গে।
হাঁ করে তাসটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিনজনে।
রবিন, একটা ভাগ্যতাস তুলে নাও। আরেক গাদা তাস রবিনের দিকে ঠেলে দিল কিশোর।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল রবিন। তারপর ভাগ্যতাসের প থেকে সবচেয়ে ওপরের তাসটা তুলে নিয়ে ওল্টাল। দুটো কালো রঙের তীর এমন করে বাঁকা। করে আঁকা হয়েছে, ফলার মাখা দুটো পরস্পরের দিকে মুখ করে আছে।
এর মানে কি? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল রবিন।
এটা হলো নিয়ন্ত্রক তাস, কিশোর বলল। এর সাহায্যে চরিত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তুমি। তুমি আর এখন গথ নও। ড্রাগনটাকে চালু করো।
হ্যাঁ, করছি।
চোখ বুজল মুসা। স্বপ্নের দৃশ্যগুলো ভেসে উঠল আবার মনের পর্দায়। শোবার ঘরে চিৎকার-চেঁচামেচি আর গর্জন করতে থাকা, কুৎসিত ভয়ঙ্কর জানোয়ারগুলোর চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল।
নাহ, খেলাটা চালিয়ে যেতে ভাল লাগছে না তার।
চোখ মেলে দেখল, পাশাগুলো রবিনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিশোর। শক্তি সঞ্চয় করো। দেখাও তোমার ড্রাগনটা কত শক্তিশালী! নাক দিয়ে খোতখেত শব্দ করল সে। দুই-এক পয়েন্ট পেয়ে বোনো না আবার।
পাশা চালল রবিন। চারটেই গড়িয়ে দিল একসঙ্গে। দুটো ছক্কা, একটা পচ, একটা চার।
দারুণ! চমৎকার! চিৎকার করে টেবিলে কিল মারল কিশোর। সাংঘাতিক শক্তিশালী করে তুলেছ ড্রাগনটাকে!
ড্রাগনের শক্তিশালী হবার কথা শুনে পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরল মুসার।
এখনও আমি রাজা, তাই না? মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল সে। নাইটেরা এখনও আমার দখলে?
মাথা ঝাঁকাল কিলোর।
বেশ, মুসা বলল। আমি তাহলে আমার সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছি ড্রাগনটাকে ধ্বংস করার জন্যে।
পাশাগুলোর জন্যে হাত বাড়াল সে।
হাতটা সরিয়ে দিল কিশোর। এখন আমার পালা। রবিনের দিকে তাকিয়ে হাসল। ড্রাগনের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় হয়েছে ক্রেলের।
মানে? বুঝতে পারল না মুসা।
ক্রেলেরা ভীষণ চালাক, কিশোর বলল। খুব সাবধানী। কখন কোন পক্ষ নিয়ে খেলতে হবে, ভাল করেই জানে।
কিন্তু এর মানেটা কি?
এত সহজ কথাটা বুঝলে না? আমি আমার শক্তি ড্রাগনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলব।
সাংঘাতিক হবে তাহলে? চিৎকার করে উঠল রবিন। আমাদের মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হবে দুষ্ট রাজা, সে যত শক্তিশালীই হোক।
কাজটা কি ঠিক হলো? জিজ্ঞেস করল মুসা।
না হওয়ার কি হলো? খেলা খেলাই।
তাসের গাদা থেকে সবচেয়ে ওপরের তাসটা টেনে নিল সে। ওল্টাল। দাড়িওলা একটা এলফের ছবি। বাদামী অ্যাপ্রন পরে আছে কল্পিত বামন-মানবের মত প্রাণীটা। হাতে মাছ ধরার জাল।
একজন এলফ জেলে, বলে পাশাগুলোকে গড়িয়ে দিল কিশোর। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছ তুমি, রাজা। সেনাবাহিনী হিসেবে লড়াই করার জন্যে দুই হাজার এলফ জেলেকে তার পক্ষে পেয়ে গেছে ক্রেল। নিঃশব্দে তোমার নাইটদের কাছে গিয়ে মাথার ওপর জাল ফেলবে এলফরা। ওদের পরাস্ত করে তোমার ওপর হামলা চালাবে। বাঁচাটা কঠিন হয়ে গেছে তোমার জন্যে।
এত্ত সহজ না! আবার খেলায় ফিরে আসতে শুরু করেছে মুসা। তাসের খেলা।
এতই সহজ, জবাব দিল কিশোর।
তারমানে আমাকে আটকে ফেলা হয়েছে?
হ্যাঁ, তুমি এখন ক্রেলের হাতে বন্দি, ঘোষণা করল কিশোর। পাশাগুলো রবিনের দিকে ঠেলে দিল। রাজা এখন বন্দি। ড্রাগন আসছে তাকে খতম করার জন্যে।
না না, দাঁড়াও! দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠল মুসা।
কিন্তু ততক্ষণে পাশা গড়িয়ে দিয়েছে রবিন।
রাস্তার দিক থেকে গর্জন শোনা গেল।
খানিক পরেই মহিলাকণ্ঠের চিৎকার।
গাড়ির চাকার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। পরক্ষণে সংঘর্ষের শব্দ।
আবার শোনা গেল খেপে ওঠা জান্তব গর্জন। আগের চেয়ে জোরে। আরও কাছে থেকে।
কিশোর আর রবিনের চেহারায় বিস্ময়।
মনেপ্রাণে দোয়া চাইতে শুরু করল মুসা, ড্রাগনটা যাতে জ্যান্ত হয়ে উঠতে না পারে।
.
১১.
লাফ দিয়ে উঠে জানালার দিকে দৌড় দিল মুসা।
হই-হট্টগোল শুরু হয়েছে।
আরেকটা গাড়ি থামার শব্দ হলো। ব্রেক কষার ফলে কর্কশ আর্তনাদ করে উঠল চাকা।