বিছানায় বসে রইল সে। পুরো সজাগ। জানালার পর্দা ভেদ করে ঘরে আসছে সকালের কমলা রোদ।
জানালার কাঁচ! না, ভাঙেনি তো! ভাঙেনি!
ওয়ালপেপারও কাটেনি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পা রাখল বিছানার বাইরে। উঠে দাঁড়াল।
কিন্তু মেঝের দিকে চোখ পড়তেই খাড়া থাকতে পারল না আর। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। সমস্ত কার্পেটে কাদা। কাদামাখা অসংখ্য পায়ের ছাপ। ছোট, বড়, নানা রকম।
নিজের অজান্তেই একটা অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে।
নিশ্চয় তাসের কাণ্ড! বিড়বিড় করল সে। দুই হাতে শক্ত করে নিজের বুক জড়িয়ে ধরল। কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করল।
সর্বনেশে তাসের খেলা! আর কিছু না!
ওই তাসগুলোর কবল থেকে মুক্তি দরকার। যতক্ষণ ঘরে আছে ওগুলো, এই অত্যাচার চলতেই থাকবে। বাঁচতে চাইলে কাকু-কাকুকে তার জিনিস ফিরিয়ে দিয়ে আসা দরকার।
নিজেকে টেনে তুলল আবার। খাড়া হলো।
ঠিক করল, এখনই ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ নয়। তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে নিয়ে দিয়ে আসবে গিয়ে এখনই।
মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে। সামনের সিঁড়ির ওপর রেখে এলেও হয়।
হ্যাঁ। তা-ই করবে। তাসের খেলা
তার সঙ্গে কথা বলার কোন দরকার নেই। চুরি করা যে কত বড় অপরাধ, সেই উপদেশ শোনারও প্রয়োজন নেই।
ওসব তার জানা। অন্যের কাছ থেকে সদুপদেশ নেয়া লাগবে না। তা ছাড়া সে নিজে চুরি করেনি। তাস খেলতে গিয়ে অন্যের বাড়িঘর ধ্বংসটাও ইচ্ছে করে করেনি। কি করে জানবে, তাস খেলা বাস্তব হয়ে ওঠে! নিজের চোখে না দেখলে পাগলেও বিশ্বাস করবে না। সে নিজেও করত না। অন্যায় একটাই করেছে, মিথ্যে কথা বলে। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাসগুলো দিয়ে দেয়া উচিত ছিল কাকু-কাকুক। দিয়ে দিতও। কাকু-কাকুর ভয়েই দিতে পারেনি। দিতে গেলে ঠিকই চোর বলত।
একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরে অনেকটা শান্ত হয়ে এল সে। ভাল লাগছে এখন। কাকু-কাকুর মুখোমুখি না হয়ে কি ভাবে ফেরত দেবে, সেটাও ঠিক করে ফেলল।
জিনসের প্যান্ট আর একটা টি-শার্ট পরে নিল। জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে দেখে হাত কাঁপছে। কই? শান্ত হলো কোথায়?
বড় করে দম নিল।
মুসা, সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজেকে বোঝাল সে। তাসগুলো শুধু ফিরিয়ে দিয়ে এসো। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কিন্তু তাসগুলো রাখল কোথায়?
ড্রেসারের ওপর।
ড্রেসারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
কিন্তু তাসগুলো নেই সেখানে।
.
০৯.
ড্রেসারের ওপর জিনিসপত্রের অভাব নেই। এলোমেলো। এক মহা বিশৃঙ্খল অবস্থা। তার মধ্যেই খুঁজতে শুরু করল সে। পেল না।
হাঁটু গেড়ে বসে ড্রেসারের নিচে খুঁজল। সেখানেও নেই তাসগুলো।
নিচতলা থেকে কথার শব্দ আসছে। রবিনের হাসি চিনতে পারল। চেয়ার টানার শব্দ হলো। সকাল সকালই চলে এসেছে। নিশ্চয় তাসের নেশায়।
এতক্ষণে মনে পড়ল, তাসগুলো নিচেই ফেলে এসেছে। নিচতলায়। রান্নাঘরের টেবিলের ওপর।
মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত এগোল সিঁড়ির দিকে।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখল টেবিলে বসে আছে কিশোর আর রবিন। তাসগুলোকে আগের মত চার ভাগে ভাগ করেছে আবার কিশোর।
ঠিকই অনুমান করেছিল মুসা। তাসের নেশাতেই অত সকালে হাজির হয়ে গেছে কিশোর আর রবিন।
কিন্তু মা-বাবা কোথায়? ঘুম থেকেই ওঠেনি এখনও? নাকি বাইরে বেরিয়ে গেছে? বাইরেই গেছে হয়তো। যাবার কথা আছে।
তোমার জন্যেই বসে আছি আমরা, রবিন বলল। তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি।
মার সঙ্গে দেখা হয়েছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। আঙ্কেল-আন্টি দুজনেই বাইরে গেছেন। কি নাকি জরুরী কাজ আছে।
তুমি জলদি জলদি নাস্তা খেয়ে নাও, কিশোর বলল। তাস নিয়ে শাফল করতে শুরু করল সে।
আবার খেলা! চিৎকার করে উঠল মুসা। বাক্সে ঢোকাও। কাকু-কাকুকে ফেরত দিয়ে আসব। এখনই।
এখনই? ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। খেলাটা শেষ না করেই? মাত্র তো অর্ধেক খেলোম।
মাত্র একটা দুর্গকে ধ্বংস করেছ, রবিন বলল। জিততে আরম্ভ করেছ। কিন্তু আমাদেরকে, অর্থাৎ গথ আর ক্রেলদের তোমাকে ধরার একটা সুযোগ দেয়া উচিত।
পারব না! মুসা বলল। তোমাদের হলোটা কি? খেলাটা ভয়ানক বিপজ্জনক। আমাদের পাশের বাড়িটার অবস্থা দেখনি? কাকু-কাকু তো সাবধানই করে দিয়ে গেছে আমাদের। বলেছে…
সেটাই তো দেখতে চাইছি, কিশোর বলল, সত্যি কথা বলেছে কিনা। ওর রূপকথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না আমার। করতে হলে আরও প্রমাণ চাই। ছোটদের ঘৃণা করে সে। ভাল করেই জানো।
আমাদের ভয় দেখানোর জন্যেও বানিয়ে বলতে পারে, রবিন বলল। তুমি তার কথা বিশ্বাস করে ভয় পেয়েছ, মুসা। তাসের চরিত্র কখনও বাস্তব হতে পারে না। তোমাকে বোকা বানিয়েছে।
কিন্তু…কিন্তু… কথা খুঁজে পাচ্ছে না মুসা। হ্যামলিনদের বাড়িটা?
তুফানে ধসে পড়েছে, রবিন বলল। ঝড়ে এরচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয় ঘরবাড়ির।
কিন্তু বিদ্যুৎ আঁকা তাসটা আমি তুলে নেয়ার আগে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়নি! তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মুসার কণ্ঠ।
কিশোর আর রবিন দুজনেই হেসে উঠল।
তারমানে ওসব ভুয়া কথা সত্যি বিশ্বাস করে বসে আছ তুমি? কিশোর বলল।
বোসো, রবিন বলল। অকারণে সময় নষ্ট করছ। এসো, শেষ করে ফেলি খেলাটা।
দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। খেলাটা চালিয়ে যাবে, মনস্থির করে ফেলেছে ওরা। কিশোর যখন একবার ঠিক করেছে খেলবে, খেলবেই। কোন কথা বলেই থামানো যাবে না ওকে।