গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভিড়ের জন্যে লোকটাকে চোখে পড়ল না মুসার। ভাবল ভেতরেই কোথাও আছে। ধাক্কা দিয়ে লোক সরিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল সে। চিৎকার করে উঠল এক মহিলা। কনুইয়ের তো খেয়ে পড়ে যেতে যেতে বাঁচল দু-জন লোক। রাগে, বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ওরা। কয়েকজনের হাতে পিস্তল, ওপর দিকে তুলে ফাঁকা গুলি করতে শুরু করল, মজা করার জন্যে। বেড়ে গেল চিৎকার-চেঁচামেচি। শিস দিয়ে উঠল কে যেন।
ভিড় থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ব্যারেট ক্যাপ পরী ছোটখাট একজন মানুষ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, কাট! কাট! কাট!
একজন বিশালদেহী অভিনেতাকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করেছে মুসা। ভিড়ের মধ্যে তাকে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল লোকটা। অনেক টানা-হাচড়া করে দু-জনকে আলাদা করা হলো।
এগিয়ে এলেন নীল টুপি পরা ভদ্রলোক। চোখের তারা উজ্জল। দেখেই চিনে ফেলল মুসা। বিড়বিড় করল আনমনে, খাইছে! পরিচালক! এইবার বারোটা বাজাবেন আমার!
ঠকা খেয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তার, সেজন্যেই এ রকম একটা কাণ্ড ঘটাতে পেরেছে।
মুসার সামনে দাঁড়িয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলালেন পরিচালক। মুসাকে বিমূঢ় করে দিয়ে আচমকা তার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন, দারুণ! দুর্দান্ত অভিনয়, ইয়াং ম্যনি! এই জিনিসই চাচ্ছিলাম আমি! ভিড়ের মধ্যে গণ্ডগোল! একেবারে বাস্তব হয়েছে দৃশ্যটা!
তোতলাতে শুরু করল মুসা, কি-কি-কিন্তু আমি তো অভিনয় করিনি! ম্যাট উইণ্ডসর নামে একটা লোককে খুঁজতে ঢুকেছিলাম। আমাকে ঢুকতে বাধা দিল ওরা, তাই খেপে গিয়েছিলাম।
সেটের চারপাশে চোখ বোলালেন পরিচালক। বোধহয় চলে গেছে। তুমি আসার একটু আগে শটটা নেয়া শেষ করেছি, যেটাতে ম্যাট অভিনয়। করছিল। শেষ হতেই চলে গেছে।
মুসার চেহারা দেখে মনে হলো ধসে পড়বে সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ডাকাতি করে নিয়ে গেছে আমার সব টাকা! ক্যামেরাটা বিক্রি করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন।
এগিয়ে এল কিশোর। মুসার হাত ধরে টান দিল, পাগল হয়ে গেলে নাকি? এসো।
ভিড়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, টাকার জন্যে ক্যামেরা বিক্রি করতে হবে কেন তোমার? আমরা আছি?
রবিন যোগ করল, তা ছাড়া এই কেসের জন্যে ওরকম একটা ক্যামেরা আমাদের দরকার হতে পারে।
কিশোর বলল, একটু দাঁড়াও। আমি পরিচালকের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে আসি।
পরিচালককে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ম্যাট উইণ্ডসর কোথায় থাকে জানেন?
না। অফিসে খোঁজ করতে পারো। হয়তো ওদের কাছে ঠিকানা আছে।
কিন্তু অফিসের ওরাও কিছু বলতে পারল না। লোকটা ভবঘুরে টাইপের। মাঝে মাঝে এসে উদয় হয়। অভিনয়ের কাজ পেলে করে। নগদ টাকায় পাওনা বুঝে নিয়ে চলে যায়।
মুসরি টাকাটা উদ্ধারের আর কোন উপায় দেখল না কিশোর। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
হোটেলে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকটা শান্ত হলো মুসৗ। টাকার শোকের চেয়ে ঠকা খাওয়ার শোকটাই তার বেশি। বলল, লস অ্যাঞ্জেলেসে তার এক চাচা থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
মুসা চলে গেল চাচার বাড়িতে, রবিন আর কিশোর চলল মিসেস লফারের সঙ্গে দেখা করতে।
পরিচয় পেয়ে গোয়েন্দাদের স্বাগত জানিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এল মিসেস লফার। বেশ সুন্দরী। বয়েস কম। স্বামীর জন্যে খুবই চিন্তিত। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে।
নয় বছরের একটা ছেলে ঢুকল ঘরে। বাদামী চুল। মুখ ভর্তি তিল। অস্বস্তি নিয়ে তাকাতে লাগল কিশোর আর রবিনের দিকে।
তা আরও একটা ছেলে ঢুকল, তার বয়েস সাত। বোঝা গেল বড় ছেলেটার ভাই।
বড়টার নাম পল, ছোটটা নেল, গোয়েন্দাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ওদের মা। আদর করে বলল, তোমরা একটু ওঘরে যাও। আমি কথা বলে আসি।
ছেলে দুটো চলে গেলে করুণ সুরে মিসেস লফার বলল, বাপের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ওরা। বুঝতেই পারছি না কি ঘটল! তোমরা তার খোঁজ এনে দিতে পারলে চির কৃতজ্ঞ থাকব তোমাদের কাছে!
আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব আমরা, কিশোর বলল।
মিসেস লফারের কাছেও নতুন কিছু জানতে পারল না ওরা। কেবল একটা ব্যাপার সঙ্গে করে বাড়তি কাপড় নেয়নি লফার। তারমানে বাইরে কোথাও থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি সে।
লফারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার অফিসে চলে এল কিশোররা। দোতলার একটা দরজায় দেখা গেল নেমপ্লেট। টোকা দিল কিশোর।
সোনালি চুল এক মহিলা দরজা ফাঁক করল। বয়েসে তরুণী, সাতাশ আটাশ হবে। লফারের সেক্রেটারি, আন্দাজ করল কিশোর।
কি চাই? জানতে চাইল মহিলা।
দেখুন, আমরা মিস্টার লফারের ব্যাপারে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।
কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল সেক্রেটারি।
০৬.
শুনুন, শুনুন! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
আবার ফাঁক হলো দরজা। আগের চেয়ে কম। ভয় পেয়েছে মহিলা।
ভয় নেই, আমাদের ঢুকতে দিন, কিশোর বলল। আমরা মিসেস লফারের কাছ থেকে এসেছি।
দ্বিধা করল মহিলা। কি করে বিশ্বাস করব?
ফোন করুন। জিজ্ঞেস করুন কিশোর আর রবিন তাঁর কাছে গিয়েছিল কিনা?
দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার। অপেক্ষা করতে লাগল দুই গোয়েন্দা। খুলল পাঁচ মিনিট পর। ভয় চলে গেছে মহিলার। ডাকল, এসো।
কিশোররা ঢুকতে আবার দরজা লাগিয়ে একেবারে তালা দিয়ে দিল সে। আর কেউ নেই ঘরে। ছোট ডেস্কে রাখা নেমপ্লেট দেখে জানা গেল মহিলা লফারের সেক্রেটারি, এবং তার নাম মিস পলী লয়েড।