বৃষ্টি ভেজা মাঠ পেরিয়ে বনে ঢুকল দুটো ঘোড়া। বনের ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চেনা পথ, তবুও ভুল হয়ে যেতে চায়। এসব কাজে মুসা কিশোরের চেয়ে পারদর্শী। কাজেই এখন আগে আগে চলল সে।
গাছের ডালে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। পাহাড়ের ঢালে উঠে কয়েকবার করে। পা পিছলাল দুটো ঘোড়াই। বন পেরিয়ে খোলা জায়গা। চলে এল ওরা সেই শৈলশিরাটায়, যেখানে অদৃশ্য হয়েছিল হারিকেন। ঢাল বেয়ে নদীর পাড়ে নামাটাই হল সবচেয়ে কঠিন। জেনারেল উইলির মত ভাল ঘোড়াও নামতে রাজি হতে চাইল না। জোরজার করেই নামাতে হলো।
তবে নামল নিরাপদেই।
নদীর পাড়ে ঘোড়ার পায়ের তাজা ছাপ দেখে আশা বাড়ল কিশোরের। তবে পাশে মানুষের পায়ের ছাপ নেই। অবাক কাণ্ড! তাহলে কি ইউনিকনের পিঠে চড়েই গেছে? সেটা করে থাকলে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে। যেভাবেই যাক, তার অনুমান। ঠিক, বেনির কোরালের দিকেই গেছে চোর।
নদীর পাড় ধরে পশ্চিমে এগোল দুজনে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে পাহাড়ের মাথায়। মুষল ধারে ঝরছে বৃষ্টি। কিশোরের মনে হলো হাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। ঠাণ্ডা।
নদীর কাছ থেকে সরে এল পথ। তবে চিহ্ন দেখে এগোতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে গেছে মাটি। তাতে স্পষ্ট বসে আছে খুরের তাজা দাগ।
ঘন বনের ভেতরে ঢুকল আবার ওরা।
হঠাৎ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাকটাস। জেনারেল উইলি থামল তার পেছনে। নিশ্চয় কিছু আঁচ করেছে। টর্চের আলোয় কিছু দেখা গেল না। ঘোড়া। দুটোকে আবার আগে বাড়ার নির্দেশ দিল দুজনে।
তবে বেশি দূর আর যেতে হলো না। গিরিখাতের ভেতরে বেড়া আর গেট দেখা গেল। তিনপাশে পাহাড়ের দেয়াল, আরেক পাশে বেড়া দিয়ে ঘিরে কোরাল তৈরি করা হয়েছে। গাছপালা নেই ভেতরে। জানা না থাকলে জায়গাটা সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কল্পনাই করবে না কেউ এখানে এরকম একটা কোরাল রয়েছে।
আরও কাছে গিয়ে র্যাসিংট্রাক দেখা গেল। কিছু তেলের খালি ড্রাম রয়েছে, ব্যারেল রেসিঙে ব্যবহারের জন্যে। আর একধারে পাহাড়ের গা ঘেষে ঘন গাছের জটলার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়ল খড়ের ছাউনির চালার সামান্য একটুখানি।
ফোঁস ফোঁস করছে জেনারেল। ঘোড়াটাকে আর এগোতে বলল না কিশোর। নেমে পড়ে লাগাম বাধল বেড়ার একটা খুঁটিতে। মুসাও নামল।
পা টিপে টিপে এগোল দুজনে কাদা মাড়িয়ে।
গাছগুলোর কাছাকাছি আসতেই ভেতরে শোনা গেল ঘোড়ার ডাক। আর। কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের, ঠিক জায়গাতেই এসেছে। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল সে। তেলচিটে গন্ধ এসে লাগল নাকে।
প্রথমেই টর্চের আলো পড়ল একটা কালো ঘোড়ার ওপর। ভেজা শরীর। টপটপ করে পানি ঝরে পড়ছে গা থেকে। ইউনিকর্ন। মুসার টর্চের আলো পড়ল আরেকটা ঘোড়ার ওপর। ওটার গা শুকনো। হারিকেন। আরও একটা ঘোড়া দেখা গেল, ওটাও পরিচিত, ওটারও গা ভেজা।
একটা ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল একজন মানুষ।
ডেকে বলল কিশোর, আর লুকিয়ে লাভ নেই, বেনি, বেরিয়ে আসুন।
বেরিয়ে এল বেনি। পরনে সাধারণ জিন্স আর শার্ট। ঘোড়সওয়ারের পোশাক নয়, যাতে লোকের সন্দেহ হতে পারে। তবে কোমরের বেল্টটা নজর এড়াল না। কিশোরের। রুপার বাকলসওয়ালাটাই পরেছে।
মুখের পানি মুছে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এটা দিয়েই আমাকে বাড়ি মেরেছিলেন, তাই না?
জবাব দিল না বেনি। বিমূঢ় হয়ে গেছে। চোখে ভয়। কল্পনাই করতে পারেনি এই বাদলার রাতে তার পিছু নেবে দুই গোয়েন্দা।
.
পালানর চেষ্টা করেনি বেনি। বুঝতে পেরেছে, পালিয়ে লাভ নেই। দুর্ভাগ্যটা মেনে নিল। তাকে আর চোরাই ঘোড়াদুটোকে নিয়ে ফিরে চলেছে কিশোর আর রবিন। নদীর পাড় থেকে ওপরে উঠতেই চোখেমুখে এসে পড়ল উজ্জ্বল আলো। দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল ঘোড়সওয়ার।
রবিন এসেছে স্যাণ্ডির পিঠে চড়ে, অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে পা ঠুকছে ঘোড়াটা। বড় একটা ঘোড়ায় চড়ে এসেছে লিলি। ব্রড আর লুকও এসেছে ওদের সাথে। আরও একজন আছেন, ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড।
ব্রড বলল, বেনি, আমি কল্পনাই করতে পারিনি… কথা আটকে গেল তার।
জবাব দিল না বেনি। পাথর হয়ে গেছে যেন। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
লিলি বলল ব্রডকে, থাক, এখন আর কথা বলে লাভ নেই। বাড়ি চলো।
.
পরদিন ডাবল সিতে আবার এলেন ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড। আকাশে মেঘ আছে এখনও, তবে আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। মাটি ভেজা। বাতাস খুবই তাজা আর পরিষ্কার। সামনের বারান্দায় বসে আছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা। লেমোনেড খাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিলেন ফোর্ড। ভাবলাম, তোমাদেরকে খবরটা দিয়েই যাই। শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছ হয়তো। বেনিকে ধরা হয়েছে। সব কথা স্বীকার করেছে সে। ব্রড জেসন এতে জড়িত নেই।
আমি জানতাম, খুশি হলো লিলি। ও আমাকে সত্যি কথাই বলেছে।
ঘোড়াগুলোকে অদলবদল লিলি একাই করেছে, হারিকেনের পিঠে চড়ে নিয়ে গেছে, ঠিক কিশোর যা সন্দেহ করেছিল। গাড়ির নিচে বাজিও সে-ই রেখেছে, কিশোরের ব্যাগে সাপ ঢুকিয়েছে। রোজই এখানে আসত ব্রডের সাথে দেখা করতে, ওই সময়ই করেছে অকাজগুলো। ঘোড়াকে ওষুধ খাওয়ার সময় আরেকটু হলেই ওকে ধরে ফেলেছিল কিশোর, বেল্ট দিয়ে বাড়ি মেরে যদি তোমাকে বেহুশ করে না ফেলত সে।