থালাবাসন ধুতে ভালই লাগে আমার, কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই হেসে বললেন মহিলা।
খাওয়ার পরেও কাজ আছে অনেক। সেগুলো করতে লাগল সবাই। বলা বাহুল্য এবারেও মিসেস ব্যানার কিছু করলেন না। রেগে গিয়ে মুসা বলল, বেটিকে খেতেই দেয়া উচিত হয়নি।
চুপ! শুনবে! থামিয়ে দিল ওকে রবিন।
বনের ভেতর লম্বা হতে লাগল ছায়া। গিটার বের করল ব্রড। সাঁঝের গান ধরল ঘরেফেরা পাখিরা, শান্ত একটানা সুরে কুলকুল করে চলেছে পাহাড়ী নদী। গাছের ডালে ডালে ফিসফিস করে গেল একঝলক হাওয়া। গোধূলির আকাশে প্রথম তারাটা মিটমিট করতে দেখল কিশোর।
রাত নামল। আগুনের লাল আলো বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করল। চাঁদ উঠল একটু পরেই। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার বন্যায় ভেসে গেল যেন বন, পাহাড়, নদী। মুসার মনে হতে লাগল, ডালপাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গলে পড়ছে হলুদ আলো।
আরেক কাপ করে কফি সরবরাহ করা হল, আর কেরোলিনের তৈরি চমৎকার ওটমিল কুকির একটা করে প্যাকেট।
যাই বল, রাতটা বড় সুন্দর, কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল মুসা। আসনপিড়ি হয়ে বসেছে আগুনের ধারে।
কয়েক মিনিট পরে হাতমুখ ধোয়ার জন্যে আঁকাবাকা বুনো পথ ধরে নদীতে চলল কিশোর আর মুসা। সাথে টর্চ নিয়েছে কিশোর। আগে আগে নেচে নেচে চলেছে তার টর্চের আলো।
হঠাৎ আলো নিভিয়ে দিয়ে মুসার বাহুতে হাত রাখল সে। চুপ থাকার ইঙ্গিতটা। বুঝতে পারল গোয়েন্দা সহকারী। দাঁড়িয়ে গেল দুজনেই। শব্দ করল না।
গাছের ফাঁক দিয়ে দেখল ওরা, একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে ব্রড জেসন। ডালের ফাঁক দিয়ে এসে পড়া জ্যোৎস্নায় মেয়েটার চুল রুপালি লাগছে। বেনি কুপারকে চিনতে অসুবিধে হলো না ওদের। এখানে কি করছে সে? তাকে আসতে দাওয়াত করা হয়নি।
মুসার হাতে আলতো চাপ দিয়ে পা টিপে টিপে এগোল কিশোর। পাইন। নীডল ঢেকে দিল তার জুতোর শব্দ। কান খাড়া করে আছে। কিন্তু ক্যাম্পের কথাবার্তা আর নদীর গুঞ্জনে দুজনের কথা ঠিকমত শুনতে পেল না। বেনির বলা কয়েকটা শব্দ বুঝতে পারল, হারিকেন, রোডিও।
বেশি ভাবছ, ব্রড বলল। বেনির কাঁধ চাপড়ে দিল।
দম বন্ধ করে রেখে আরও কয়েক পা এগোল কিশোর। গাছের আড়াল থেকে সামনে মাথা বের করে দিল। …আমার খারাপ লাগতে শুরু করার আগেই চলে যাও, ব্রডের কথা শোনা গেল। আর দাঁড়াল না সে। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটে চলে গেল।
বেনির পিছু নিল কিশোর। আশা করল, ইউনিকনের কাছে তাকে নিয়ে যাবে। মেয়েটা। ওটার পিঠে চড়েই এল নাকি?
নদীর সরু অংশে একটা গাছ পড়ে আছে আড়াআড়ি, সাঁকো তৈরি করে দিয়েছে। সেটা দিয়ে নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেল বেনি। ইউনিকর্ন নয়, অন্য একটা ঘোড়া নিয়ে এসেছে সে। সেটার পিঠে চেপে রওনা হয়ে গেল ওদের র্যাঞ্চটার দিকে।
আবার মুসার কাছে ফিরে এল কিশোর।
কিছু দেখলে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছে মুসা।
তেমন কিছু না। কথাও ঠিকমত শুনতে পারলাম না। তবে যা মনে হল, অনেক কথা চেপে রেখেছে ব্রড আর বেনি। রোডিও খেলা আর হারিকেনকে নিয়ে। আলোচনা করছিল ওরা।
জানতাম! যত শয়তানী ওদেরই।
প্রমাণটমাণ থাকলে এখন ধরতে পারতাম, নিজেকেই যেন বলল কিশোর।
ক্যাম্পে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল রবিনের সঙ্গে। ওদের দেরি দেখেই দেখতে আসছিল কিছু হলো কিনা। বলল, লুক আমাকে পাঠিয়েছে দেখার জন্যে।
চলতে চলতে সব কথা তাকে জানাল কিশোর।
পাইক আর নিরেকের ব্যাপারটা কি তাহলে? রবিনের প্রশ্ন। ওরাও কি ব্রড আর বেনির সঙ্গে জড়িত? নাকি ওদের সঙ্গে এরা দুজন গিয়ে হাত মিলিয়েছে?
জানি না, আসলেই কিছু বুঝতে পারছে না কিশোর। ওই ঘোড়া চুরির ব্যাপারে হয়ত কিছুই জানে না পাইকেরা। ব্রড আর বেনিই করেছে।
তবে মোটিভ দুই দলেরই আছে। হতে পারে, না জেনেই একদল আরেক। দলের সাহায্য করে চলেছে।
এর মানে, মুসা বলল, ব্রড আর বেনি দুজনেই চাইছে লিলি রোডিওতে যোগ দিতে না পারুক, যাতে বেনির জেতাটা নিশ্চিত হয়…
কিংবা নিরেক আর পাইক চাইছে, রবিন বলল, গোলমাল বাধিয়ে দিয়ে লিলিকে সরাতে, যাতে র্যাঞ্চটা ওরা দখল করতে পারে।
কিশোর কিছু বলছে না। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে।
ওদেরকে দেখে লুক বলল, অনেক দেরি করে ফেললে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল চোখে সন্দেহ নিয়ে। তারপর বলল, রাত হয়েছে। এবার শুতে যাও।
স্লীপিং ব্যাগটা যেখানে রেখেছিল সেখানে পেল না কিশোর। টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে খানিক দূরে, গাছের জটলার ভেতরে। আশ্চর্য! বিড়বিড় করল,
কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আমার স্লীপিং ব্যাগ। মালপত্র থেকে খুলে নিয়ে গিয়ে ওখানে ফেলে রেখেছে।
ভুলে নিজের মনে করে কেউ খুলেছিল হয়ত। চলো, নিয়ে আসি।
চলো।
ব্যাগ তোলার জন্যে হাত বাড়িয়েই থমকে গেল কিশোর। পরিচিত একটা শব্দ। তবে কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। ছোট ছোট নুড়ি থলেতে রেখে ঝাঁকালে যেমন শব্দ হয় অনেকটা তেমনি।
ধুকধুক করছে তার বুক। কি আছে ব্যাগের ভেতরে? খুব সাবধানে ব্যাগটা খুলে দুই কোণ ধরে উপুড় করল, ঝাঁকি দিল জোরে জোরে।
ভেতর থেকে পড়ল একটা সাপ। মাটিতে পড়েই হিসহিস করে ফণা তুলল। ছোবল মারার জন্যে। মারাত্মক বিষাক্ত র্যাটল স্নেক।
.
১১.
চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ছুটে এল ব্রড। কি হয়েছে? চেঁচাও কেন?