ধুলো ঢাকা মাটিতে লাফিয়ে, নামল গোয়েন্দারা। চত্বরে থেকেই আস্তাবল, গোলাঘর আর বাঙ্কহাউস দেখতে পাচ্ছে কিশোর। সবগুলো ঘরই সাদা রঙ করা হয়েছিল। মলিন ফেকাসে হয়ে গেছে এখন, ধূসর হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। কাত হয়ে রয়েছে বেড়া। পুরো জায়গাটারই কেমন বিবর্ণ দরিদ্র চেহারা।
সাংঘাতিক মোটা, ধূসর রঙের চুলওয়ালা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন সামনের দরজার কাছে। তিনিই কেরোলিন হোফারসন, এই র্যাঞ্চের হাউসকীপার, রবিনের মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী, স্কুলে একসাথে পড়েছেন। তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করেছেন, র্যাঞ্চে এসে ছুটি কাটানোর জন্যে।
ফিসফিস করে মুসা বলল, কিশোর, এ-কি! ব্রশিয়ারে কি দেখলাম, আর এসে কি দেখছি? এই অবস্থা তো কল্পনা করিনি।
রবিন! বারান্দায় দাঁড়ানো মহিলা এগিয়ে এলেন। বিশাল মুখে হাসি।
ব্যাগ হাতে দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন। আন্টি, কেমন আছেন? আমি…
আর বলতে হবে না, তুমিই রবিন। দেখেই চিনেছি।…আর তুমি কিশোর পাশা। তুমি মুসা।
গর্জন তুলে চত্বরে ঢুকল একটা ভ্যান। বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। জীপটার মতই এটার গায়েও সবুজ রঙে লেখা রয়েছে র্যাঞ্চের নামঃ ডাবল সি র্যাঞ্চ। পাশে পা তুলে দেয়া একটা কালো ঘোড়ার ছবি, র্যাঞ্চের মনোগ্রাম।
কয়েকজন নামল ভ্যান থেকে, তাদের মধ্যে রয়েছে এক তরুণী। বয়েস বিশ মত হবে, লাল চুল, মুখে হাসি। এগিয়ে এসে হাত বাড়াল প্রথমেই কিশোরের দিকে, হাই, আমি লিলি মরগান। তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা?
মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দুজনের পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর।
খুব খুশি হলাম তোমাদেরকে দেখে, হাসি এবং আন্তরিকতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে লিলির চোখ। তবে ঠোঁটের কোণে ক্লান্তির হালকা ছাপও স্পষ্ট। যাও, ভেতরে যাও। আমাদের আরও মেহমান আছে, তাদেরকে খাতির যত্ন করতে হবে আমাকে। আন্টির সঙ্গে তো পরিচয় হয়েই গেছে তোমাদের। রাঁধুনী, নার্স, অ্যাকাউনটেন্ট, হাউসকীপার, সব এক হাতেই করেন। আন্টি না থাকলে যে আমার কি দুর্গতি হত! আরেক বার হেসে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল লিলি ভ্যানের কাছে দাঁড়ান অন্য মেহমানদের দিকে।
সবই করেন তাহলে আপনি, কেরোলিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।
হাত দিয়ে ডলে অ্যাপ্রনের ভাজ সমান করতে লাগলেন তিনি। এভাবে সামনাসামনি প্রশংসায় লজ্জা পেয়েছেন। লিলির কথা আর বল না। এসো, তোমাদের ঘর দেখিয়ে দিই। হাতমুখ ধুয়ে এসো। লেমনেড খেতে দেব।
আউফ, দারুণ কথাটা বলেছেন আন্টি, মুসা বলল। এটাই চাইছিলাম এখন।
মাটিতে নামিয়ে রাখা ওর ডাফেল ব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল কিশোর। বাধা দিয়ে কেরোলিন বললেন, থাক, তোমাদের নিতে হবে না। ব্রড আর টিম আছে, দিয়ে আসবে।
হাউসকীপারের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। প্রবেশপথের মুখ থেকেই চার দিকে চলে গেছে চারটে শাখাপথ। সিঁড়ি উঠে গেছে ওগুলোর মাথা থেকে। একটা সিঁড়ির গোড়া থেকে বড় একটা হলঘর চলে গেছে বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘর পর্যন্ত। বায়ে রয়েছে ডাইনিং রুম, লম্বা লম্বা টেবিল পাতা। ওই ঘর আর রান্নাঘরের মাঝে দরজা রয়েছে, সুইংডোর লাগান। ডানে লিভিং রুম। পাইন। কাঠের প্যানেলিং করা। আসবাবপত্র সব পুরানো, মলিন, কাঠের মেঝেতে পাতা কার্পেটটাও বিবর্ণ। ছাত ধরে রেখেছে বড় বড় কড়িকাঠ। দেয়ালে আঁকা রয়েছে। ওয়াগনের ছবি। এক কোণে একটা রিভার-রক ফায়ারপ্লেস, ওটার ম্যানটেল বোঝাই হয়ে আছে নানারকম ট্রফিতে।
এসব পুরস্কার কি সব লিলি জিতে এনেছে? দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল মুসা।
সঅব। এখানে ওর মত ঘোড়ায় চড়তে পারে না আর কেউ, গর্বের সঙ্গে বললেন কেরোলিন। হাঁটতে শেখার আগেই ঘোড়ায় চড়তে শিখেছে মেয়েটা, তা ও জিন ছাড়া, ইনডিয়ানদের মত ঘোড়ার খালি পিঠে। বারো বছর বয়েসে স্থানীয় সমস্ত রোডিও প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। এর কয়েক বছর পরেই ঘোড়ার পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়েছিল দেশভ্রমণে। তাতেও পুরস্কার জিতে নিয়ে শেষে এসে এই– র্যাঞ্চের কাজে লেগেছে।
কাজে লেগেছে মানে? জানতে চাইল কিশোর।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন কেরোলিন। ওর সাহায্য দরকার হয়েছিল ওর বাবার, অ্যাক্সিডেন্টের পর। প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, এসো। ঘরে চলো। চওড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে দোতলায় নিয়ে চললেন তিনি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পাশের দেয়ালে টানানো ছবিগুলো দেখল কিশোর। ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে থামল, ফ্রেমে বাঁধাই একটা সাদা কালো ছবি দেখে। কার ছবি? লিলির বাবার? কাউবয়ের পোশাক পরা একজন মানুষের ছবি, সেদিকে হাত তুলল সে।
হাসি মলিন হয়ে এল কেরোলিনের। হ্যাঁ, লিলির বাবা। মেয়েটাকে একাই মানুষ করেছেন। লিলির মা মারা গেছে ওর পাঁচ বছর বয়েসে।
মা বলে, রবিন বলল, লিলি নাকি আপনার মেয়ের মত।
বিষণ্ণতা ফুটল কিশোরের চেহারায়। তারও মা নেই। ছোটবেলায় এক মোটর দুর্ঘটনায় বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। তারপর থেকে বড় হয়েছে মেরিচাচীর কাছে। লিলির বাবার দুর্ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল, জানতে ইচ্ছে করছে তার। জিজ্ঞেস করল, বাপ-মেয়ের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, না?
ছিল, সিঁড়ির মাথা থেকে জবাব দিলেন কেরোলিন।
লম্বা করিডরে মলিন কার্পেট পাতা। দোতলায়ও হলঘর আছে। এক প্রান্ত থেকে নেমে গেছে আরেকটা সিঁড়ি।