আর শোনার অপেক্ষা করল না জনি আর আরেকজন তরুণ শ্রমিক। লাফ দিয়ে গিয়ে উঠল একটা জীপে। লুকের গাড়ির পিছু নিল। কিশোরও দেরি করল না। ছুটে এসে ঢুকল ট্যাক রুমে। টান দিয়ে একটা জিন নামিয়ে নিয়েই দৌড় দিল বেড়ার দিকে। ওকের জটলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ঘোড়া, গোলমাল শুনে কান খাড়া করে রেখেছে।
চাঁদের আলোয় জেনারেলকে চিনতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না কিশোরের। হাত নেড়ে ডাকল, এই জেনারেল, আয়, আয়। মুখ ফিরিয়ে কিশোরের দিকে তাকাল ঘোড়াটা। তারপর দুলকি চালে এগিয়ে এল। ওটার পিঠে জিন পরাল কিশোর। লাগামটা বেড়ার সঙ্গে বেধে আবার ছুটল ট্যাক রুমে। একটা টর্চ নিয়ে এল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, চলো, জলদি চলো। ওদেরকে ধরা চাই।
মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছোটাল কিলোর। অনেকটা এগিয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে ইউনিকর্ন। কিন্তু সে যাচ্ছে কোণাকুণি, পথ বাঁচবে, ধরে ফেলতে পারবে হয়ত ঘোড়াটাকে। দূরত্ব আর জেনারেলের গতির ওপরই নির্ভর করছে এখন সে।
জীপের হেডলাইট দেখতে পাচ্ছে। আরও আগে সামনের অন্ধকারকে চিরে দিয়েছে লুকের পিকআপের আলো।
ছুটে চলেছে জেনারেল। এদিক ওদিক ঘুরছে কিশোরের চঞ্চল দৃষ্টি। হঠাৎ চোখে পড়ল ওটাকে। একটা বিশাল ঘোড়ার অবয়ব, ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের পটভূমিতে কেমন ভূতুড়ে লাগছে ইউনিকর্নের চকচকে কালো শরীর।
চল, জেনারেল, চল, তাড়া দিল কিশোর। আরও জোরে। নইলে ধরতে পারবি না।
তীর বেগে ছুটল জেনারেল।
গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ইউনিকর্ন।
বনের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল লুকের পিকআপ।
জনও ব্রেক কষল।
পেছনে আরও ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডেকে বলল লুকের খসখসে কণ্ঠ, এই কিশোর, যেও না! আর যেও না! ওদিকে পথ ভাল না! খানাখন্দে ভরা। যেও না…
শুনল না কিশোর। জেনারেলের পিঠে প্রায় শুয়ে পড়ে হাঁটু দিয়ে চাপ দিতে লাগল আরও জোরে ছোটার জন্যে। ঢুকে পড়ল বনের ভেতরে। চাঁদের আলো এখানে ঠিকমত পৌঁছতে পারছে না। গিলে নিল যেন তাকে রাতের অন্ধকার।
টর্চ জ্বেলে ইউনিকর্নকে খুঁজতে শুরু করল সে। পলকের জন্যে দেখতে পেল। ঘোড়াটাকে, মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের আড়ালে। পিছু নিল জেনারেল। এরপর যতবারই ঘোড়াটার ওপর আলো ফেলে কিশোর, ততবারই দেখে মিলিয়ে যাচ্ছে ওটা। কিছুতেই কাছে আর যেতে পারছে না। খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে রেখে যাচ্ছে ইউনিকর্ন। নাকমুখ দিয়ে সেই ধুলো গলায় ঢুকে আটকে যাচ্ছে। কিশোরের, দম নেয়াটাই অস্বস্তিকর করে তুলেছে।
জেনারেল ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। একই দিনে তিন তিনবার এভাবে ছুটতে হয়েছে তাকে। ওর ঘামে ভেজা গলা চাপড়ে দিল কিশোর। সামনে অনেকটা ফাঁকা হয়ে এসেছে গাছপালা। আবার খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। পাহাড়ের গায়ে এখন কেবল শুকনো ঘাস।
হালকা ছায়া পড়েছে এখানে চাঁদের আলোয়, আশপাশের পাহাড় আর বনের জন্যেই বোধহয় হয়েছে এরকমটা। পাহাড়ী অঞ্চলে নানা রকম অদ্ভুত কাণ্ড করে আলো আর বাতাস, অনেক দেখেছে কিশোর, খোলা জায়গায় যেটা হয় না। সামনে দেখতে পেল এখন ইউনিকর্নকে। থমকে দাঁড়াল একবার ঘোড়াটা। বাতাস। উকে কিছু বোঝার চেষ্টা করল যেন। লাফিয়ে উঠল পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে। আবার ছুটল তীব্র গতিতে।
আগে বাড়ার জন্যে লাফ দিল জেনারেলও। দম আটকে গেল যেন কিশোরের। তার মনে হলো, ইউনিকনের পিঠে চড়ে বসে আছে একজন মানুষ। মানুষটাকে দেখতে পায়নি। আন্দাজ করেছে চাঁদের আলোয় কোন ধাতব জিনিস ঝিক করে উঠতে দেখে। ওই একবারই। আর দেখা গেল না।
আবার মনে পড়ল পাহাড়ী অঞ্চলে আলোর বিচিত্র কারসাজির কথা। চোখের ভুল না তো? ইউনিকনের পিঠে আরোহী? অসম্ভব।
কিশোরের মুখ ছুঁয়ে দামাল বেগে ছুটছে রাতের বাতাস। কোন দিকেই খেয়াল নেই ওর, তাকিয়ে রয়েছে ইউনিকনের পিঠের দিকে। আবার যদি দেখতে পায়। লোকটাকে? শিওর হতে পারবে তাহলে, সত্যিই আছে।
কিন্তু গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটছে ইউনিৰ্কন। হোঁচট খেল জেনারেল। হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আরেকটু হলেই, অনেক কষ্টে সামলে নিল। শেষ মুহূর্তে জিনের একটা শিং খামচে ধরে উড়ে গিয়ে পড়া থেকে বাঁচল কিশোর। পড়লে আর রক্ষা ছিল না। এত গতিতে এরকম উঁচুনিচু শক্ত জায়গায় পড়লে ঘাড় কিংবা। কোমর ভাঙা থেকে কোন অলৌকিক কারণে রক্ষা পেলেও, হাত-পা বাঁচাতে পারত না। ভয় পেয়ে গেল সে। আর ঝুঁকি নিল না। রাশ টেনে গতি কমাল ঘোড়ার।
পাহাড়ের ঢালের পথ ধরে ছুটছেই ইউনিকর্ন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিশোর। কোনমতে, শুধু একবার যদি কোন ভাবে দেখতে পেত আরোহীটাকে…
আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল কিশোরের। আরোহী দেখার জন্যে মনযোগ সেদিকে দিয়ে না রাখলে এটা আরও আগেই চোখে পড়ত। ইউনিকনের কিছুটা সামনে বেশ অন্ধকার, ঘাসে ঢাকা জমি থাকলে যেমন দেখায় তেমন নয়। কেমন একটা শূন্যতা।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝে ফেলল, ওখানে কিছু নেই! হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে পাহাড়, তারপরে বিশাল খাদ! এবং সেদিকেই ছুটে চলেছে ইউনিকর্ন!
গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা উঠে চলে এল যেন কিশোরের। জেনারেলের গায়ে। হাঁটু দিয়ে গুতো মারল জলদি ছোটার জন্যে। লাফ দিয়ে ছুটল ঘোড়াটা। চিত্তার করে উঠল কিশোর, থাম! থাম! বাতাসে হারিয়ে গেল তার চিৎকার। কানে ঢুকল না যেন ইউনিকনের।