এখানে আসার পর থেকেই একটার পর একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কাল রাতে ইউনিকর্নের কোরালের গেট কেউ খুলে রেখেছিল। এখন হারিয়ে গেল লিলি। হারনি পাইক এসে হুমকি দিয়ে গেল। লুক বোলান, এমনকি ব্রডও এমন আচরণ করছে, মনে হচ্ছে যেন কিছু লুকাতে চায়।
কিছু সন্দেহ করছ নাকি?
এই, কি হলো তোর? জেনারেলের ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কোন কারণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা।
কর্কশ একটা ডাক শোনা গেল। ডানা ঝাঁপটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বিরাট এক পেঁচা। মাথা ঝাড়ল জেনারেল, নাক দিয়ে শব্দ করল, লাফ দিল। সামনের দুপা তুলে। এক হাতে লাগাম ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল কিশোর, আরেক হাতে টর্চ। হাত নড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও সামনের পথের ওপর নড়তে লাগল।
কি হলো? মুসার ক্যাকটাসও অস্থির হয়ে উঠেছে।
বলতে গিয়েও বলতে পারল না কিশোর, গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন, এরকম একটা শব্দ করল। সামনের পথের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মূর্তি। নড়ছে না।
.
০৪.
লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে গেল কিশোর। বসে পড়ল পড়ে থাকা দেহটার পাশে। প্রথমেই নাড়ি দেখল। তারপর মুসাকে বলল, লিলি!
লিলির ওপর ঝুঁকল মুসা। বেঁচে আছে?
আছে। কাঁধ ধরে ঠেলা দিতে দিতে কিলোর ডাকল, লিলি, শুনতে পাচ্ছেন? এই লিলি?
উ! গোঙাল লিলি। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে খুলে গেল চোখের পাতা, আবার বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর? শুকনো ঠোঁটের ভেতর দিয়ে কোনমতে ফিসফিস করে বলল সে। আবার চোখ মেলল। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে… হাত চেপে ধরল কপালে।
নড়বেন না, কিশোর বলল। হাড়টাড় কিছু ভেঙে থাকতে পারে।
না, ভাঙেনি। টর্চের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে ওর চেহারা। ইস্, মনে হচ্ছে গায়ের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। নড়াতে পারছি না। নড়লেই ব্যথা লাগে… চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে।
বাড়িটাড়ি লাগিয়েছেন বোধহয় কোথাও। শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার কাপলিংকে নিয়ে আসি।
লাগবে না। এই প্রথম যেন অন্ধকার লক্ষ্য করল। অনেকক্ষণ ধরে এখানে আছি মনে হচ্ছে? ধরো, আমাকে, তোলো, তাহলেই হবে।
কিশোর আর মুসার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল লিলি। পা কাঁপছে। ওরা ছেড়ে দিলেই টলে পড়ে যাবে।
যেতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারব না কেন? কোনমতে উঠে বসতে পারলেই হয় ঘোড়ায়, কাঁপা গলায় বলল লিলি।
ক্যাকটাস শান্ত, তাই ওটার পিঠেই ওকে তুলে দিল মুসা আর কিশোর মিলে। ওরা উঠল জেনারেলের পিঠে। টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে এগোল পাহাড়ী পথ ধরে।
হারিকেন কোথায়? জিজ্ঞেস করল লিলি।
র্যাঞ্চে। একেবারে খেপে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে শান্ত করেছে লুক আর ব্রড।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল লিলি। সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদানীং ঘোড়াগুলো কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কিছু বুঝতে পারছি না।
কি করছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অদ্ভুত সব কাণ্ড। গত হপ্তায় খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল হারিকেন। মনে হচ্ছিল, ভয়ে ভয়ে আছে। সাধারণত ওরকম থাকে না। আজকে করল এই কাণ্ড… থেমে গেল লিলি।
আপনার কি হয়েছিল কিছু মনে আছে?
হারিকেনকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম। শুরু থেকেই কেমন নার্ভাস হয়ে ছিল ও, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিল। মনে হল, কোন কারণে লাগাম সহ্য করতে পারছে না। খুলে দিলাম। তারপরই মাঠের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এল আমাকে এখানে। বনের ভেতরে ঢুকে আরও অস্থির হয়ে গেল। কিছু শুনেছিল বোধহয়, বিপদ-টি পদ আঁচ করেছিল। একটা পাইনের জটলার কাছে গিয়ে লাথি মারতে শুরু করল মাটিতে, পিঠ বাকা করে আমাকে ফেলে দিতে চাইল। শেষে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠল। মাথায় বোধহয় ডালের বাড়িটাড়ি লেগেছিল আমার। তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম তোমাদেরকে। দুজনের দিকে তাকাল সে। থ্যাঙ্কস।
র্যাঞ্চের আলো চোখে পড়ল। খানিক পরে অনেকগুলো কণ্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে। একজন শ্রমিকের চোখে পড়ে গেল লিলি। ফ্লেয়ার জ্বালল লোকটা। হাউই বাজির মত আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেল ফ্লেয়ার, তীব্র নীল আলো। লিলিকে নিয়ে কিশোর আর মুসা চত্বরে ঢুকতে অনেকে এগিয়ে এল স্বাগত জানাতে।
কয়েক মিনিট পরে লিলি যখন ঘোড়া থেকে নামছে, চত্বরে এসে ঢুকল লুকের গাড়ি। দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে এল সে। লিলিকে দেখে স্বস্তির হাসি হাসল। এসেছ! কি ভয়টাই না পাইয়েছিলে…! সব ঠিক আছে তো?
মনে হয়, জবাব দিল লিলি।
কিশোরের দিকে তাকাল লুক। মনে হচ্ছে তোমার ব্যাপারে ভুল ধারণা করেছিলাম আমি, কিশোর পাশা। বেরিয়ে ভালই করেছ। তবে, এর পরের বার আমি যা বলব, শুনবে। যা করেছ, করেছ, পরের বার আর করবে না। মারাত্মক বিপদে পড়তে পারতে, তখন?
জবাব দিল না কিশোর।
হাঁ হয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। দুহাতে অ্যাপ্রন তুলে সিঁড়ি বেয়ে। দৌড়ে নেমে এলেন কেরোলিন। পেয়েছে! যাক! লিলিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর ঠেলে সরিয়ে মুখ দেখতে লাগলেন। ইসসি, এক্কেবারেই তো সাদা হয়ে গেছে! যাও, সোজা ঘরে…আমি ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।… কি ভয়টাই না দেখালে
যার যার ঘোড়ার জিন খুলে ঘোড়াগুলোকে আগের জায়গায় রেখে এল কিশোর আর মুসা। লিভিং রুমে ঢুকে দেখল, পুরানো একটা কাউচে বসে ডক্টর কাপলিঙের মেয়ের সঙ্গে মিউজিক নিয়ে আলোচনা করছে রবিন। ওদেরকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, পেয়েছ?