থাবা দিয়ে বায়ের একটা খাঁজ আকড়ে ধরল সে। সরে যেতে শুরু করল। কপালে ঘাম। চোখ জ্বালা করছে। নাকে ঢুকছে বালি।
মরিয়া হয়ে উঠেছে রবিন। যত দ্রুত সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
বাড়ছে গুমগুম শব্দ।
অনেকটা সরে এসেছে সে। এই সময় পাশ দিয়ে ভারি গর্জন করতে করতে নেমে যেতে লাগল ধস। পাথরের খুদে কণা। তীব্র গতিতে এসে সুচের মত বিধছে চামড়ায়।
ধসটা নেমে গিয়ে জমা হল নিচের পাথরের স্তূপের সঙ্গে। তার মানে মাঝে মাঝেই ধস নামে ওই জায়গাটায়, স্থপটা ওভাবেই হয়েছে। পাহাড়ের চূড়াটা ওখানে নড়বড়ে, যে কোন ধরনের চমক ধসিয়ে দিতে পারে ওটাকে–একটা, পার্বত্য সিংহ লাফিয়ে উঠলে, একটুখানি ভূকম্পন হলে, কিংবা রোদ-বাতাস বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া একটা পাথর, চূড়ার নিচ থেকে খসে গেলেই টলে উঠবে চূড়াটা। ওখানে চড়তে যাওয়াটা মোটেও নিরাপদ নয়।
ধড়াস ধড়াস করছে রবিনের বুক। চোখ মুদল সে। একটু আগের আতঙ্কের রেশ পুরোপুরি কাটেনি এখনও।
কিন্তু চিরকাল তো আর এখানে এভাবে থাকা যাবে না।
চোখ মেলল সে। আশপাশে তাকাল। কি করবে? ওপরে উঠবে? নিচে নামবে?
এই সময় অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল তার। হাত রাখার জায়গা, না পা রাখার জায়গা? দুটোই মনে হচ্ছে। পাথর কুঁদে তৈরি প্রাকৃতিক নয়। প্রাকৃতিক কারণে ওভাবে তাক তৈরি। হতে পারে না। ঠিক তাকও বলা যাবে না। পাথরের দেয়ালে এমন ভাবে তৈরি হয়েছে ওগুলো, যাতে হাত দিয়ে চেপে ধরে পা রেখে বেয়ে ওঠা যায়।
এখনও কাঁপুনি থামেনি রবিনের। হাত বাড়ালেই তাক ধরতে পারে সে। তা ই করল। যেখানে ছিল, সেখান থেকে সরে চলে এল তাকের সারিতে। সুন্দর ভাবে ওপরের একটা খাজ ধরে নিচের একটায় পা রাখতে পারল। দেয়ালে ওঠার এক ধরনের সিঁড়ি। আরও ভালমত দেখতে পাচ্ছে এখন। বিপজ্জনক জায়গা ধরে। বহুদূর পর্যন্ত উঠে গেছে, বাঁয়ের খাড়া চুড়ার কাছাকাছি। গ্যানিট কেটে যে ইনডিয়ানরা বাদাম গুড়ো করার গর্ত করেছে তারাই হয়ত পাহাড়ে চড়ার জন্যে তৈরি করেছিল এই সিঁড়ি।
ঘড়ি দেখল রবিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যেরা নিশ্চয় তার ফেরার অপেক্ষায় আছে।
দেয়ালে পেট ঠেকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল সে। পৌঁছে গেল জলপ্রপাতের সামান্য ওপরের একটা জায়গায়। বাতাসে পানির কণা এখানে অনেক বেশি, প্রপাত থেকে উঠছে। মনে হয় হালকা বাষ্প ভাসছে বাতাসে।
আরেকটু পাশে সরে একটা নালার কাছে চলে এল সে। পানির ঘষায় সৃষ্টি হয়েছে ওটা। উঠে গেছে ওপর দিকে। ওখানে আসতেই চোখে পড়ল উপত্যকাটা। বিমান থেকে যেটা দেখেছিল সেটাই। ঘন গাছের জঙ্গল। কিছু কিছু জায়গায় অনেক চওড়া, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে না সে। মাথার ওপরে গ্র্যানিটের গায়ে রোদ চমকাচ্ছে। উপত্যকার বুক চিরে চলে গেছে পাহাড়ী নদী। কিন্তু ওটার পাড়ে ক্যাম্পগ্রাউণ্ড চোখে পড়ল না তার, যেটা আশায় এসেছিল।
উত্তর থেকে বাতাস বইছে। বয়ে আনছে গন্ধকের কটু গন্ধ, যার অর্থ, পর্বতের ভেতরে গরম পানির ঝর্না আছে কোথাও। চোখ জ্বালা করছে এখনও ওর, বোধহয় গন্ধকের জন্যেই। হাত দিয়ে ডলে মুছে নিয়ে আবার তাকাল উপত্যকার দিকে।
মনে হচ্ছে, যেন বহুকাল আগে বিমান থেকে দেখেছিল জায়গাটা। তার পর কত ঘটনা ঘটে গেছে। কপালজোরে বেঁচে রয়েছে এখনও।
আর দেখার কিছু নেই আপাতত। সিঁড়ি বেয়ে আবার নামতে শুরু করল সে। যেখানে আরেকটু হলেই ধসের আঘাতে মরতে চলেছিল সেই জায়গাটা পেরিয়ে। এল। তারপর পেরোল সরু একটা শৈলশিরা, ঘন ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে ওখানে।
সিঁড়িটার কথা ভাবছে সে। নিচে থেকে চোখে পড়ে না। কোন্ রহস্যময় কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার মত করে তৈরি করেছিল ইনডিয়ানরা কে জানে! প্রপাতের আশপাশের খোলা অঞ্চলে দাঁড়ালে সামনে বাধা হয়ে থাকে পাইন বন, ওই বনের জন্যেই ওখান থেকে দেখা যায় না সিঁড়িটা।
কয়েক ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে বনতলে নামল রবিন। আবার ঘড়ি দেখল। এবার সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে।
দৌড়ে এল পানির বোতলটা যেখানে রেখেছিল সেখানে। তুলে নিয়ে আবার দৌড়ে চলল বনের ভেতর দিয়ে। চিহ্ন ভুল করল না।
অবশেষে চোখে পড়ল তৃণভূমিটা, যেখানে নামতে বাধ্য করা হয়েছে সেসনা। সূর্য ডুবতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি। ক্লান্তি লাগছে রবিনের। উত্তেজিত। কি দেখেছে, কি ভাবে ধস থেকে বেঁচে এসেছে সবাইকে বলার জন্য অস্থির।
.
রবিনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সরু পথটা ধরে এগোল মুসা। যা অনুমান। করেছিল, তা-ই। দক্ষিণ-পুবের ঘন বনের ভেতরে ঢুকে গেছে পথটা।
উঁচু গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে নামছে সূর্যালোক, বনতলে উষ্ণ আলো আর শীতল ছায়া সৃষ্টি করেছে। বিচিত্র এক আলোআঁধারির খেলা চলছে। ওপরে গাছের মাথা, কোথাও এত গায়ে গায়ে লেগে গেছে যে আকাশই চোখে পড়ে না। মাটি আর পাইনের তাজা সুগন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস।
পথটা ধরে প্রায় আধ ঘণ্টা চলল মুসা। বালুতে মানুষের পায়ের ছাপ খুঁজল। হরিণ, ব্ল্যাকুন আর কুগারের ছাপ দেখতে পেল। পথের ওপরে আর পথের ধারে হরিণ ও ভালুকের নাদা পড়ে আছে। হতাশ হল হাইকিং বুট কিংবা টেনিস–এর ছাপ না দেখে। ক্যাম্পফায়ারের ধোয়ার গন্ধ আশা করেছিল, পেল না। কান খাড়া রেখেছে জীপের ইঞ্জিনের শব্দ শোনার জন্যে, শুনল না। টেলিফোনের থাম দেখল না। মানুষের অস্তিত্ব ঘোষণা করে এরকম কিছুই নেই।