গুঙিয়ে উঠল কিশোর। কাঠ দিয়ে একটা কেবিন বানানোর কথাটা আর বাকি রাখলে কেন?
হেসে উঠল অন্য দুজন, রবিন আর তার বাবা।
লাকড়ি কুড়াতে রাজি আছি আমি, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল কিশোর। আর কিছু পারব না।
তাহলে অনেক বেশি করে আনতে হবে, মুসা বলল। কম হলে চলবে না। অনেক বড় ধোয়া হওয়া চাই…
আসলে আমার বসে থাকাটা সহ্য করতে পারছ না তুমি…
কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে রবিন বলল, মুসা, তুমি আসল কথাটাই ভুলে যাচ্ছ। আমাদেরকে খাইয়েছে ও। কাজেই এখন ওর কাজগুলো ভাগাভাগি করে আমাদেরই করে দেয়া উচিত। না কি বলো?
তাই তো। এতক্ষণে যেন টনক নড়ল মুসার। চুপ হয়ে গেল। মাথা চুলকে আমতা আমতা করতে লাগল, ইয়ে…মানে…ইয়ে…
হেসে ফেলল এবার কিশোর। মুসাও হাসল। চলি।
হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড, চিহ্ন দিয়ে দিয়ে যেও কিন্তু। নইলে বনের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলবে।
তৃণভূমির কিনারে এসে আলাদা হয়ে গেল রবিন আর মুসা। দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরে পাইন বনে ঢুকে পড়ল রবিন। পানির মৃদু শব্দ কানে আসছে তার। সেদিকেই চলল। মুসা ঢুকল দক্ষিণ-পুবের সরু পায়ে চলা পথটা ধরে।
মা বাবার কথা মনে আছে রবিনের। চিহ্ন রেখে যাওয়া দরকার। আশপাশে কোথায় কি আছে না আছে ভাল করে দেখে দেখে চলতে হয়, বনে চলার এটাই নিয়ম, বিশেষ করে অপরিচিত এলাকায়। একটা ট্রিপল পাইন চোখে পড়ল তার। একই জায়গা থেকে তিনটে চারাগাছ গজিয়েছিল, একই গোড়া থেকে, গায়ে গায়ে লেগে সেগুলো এখন একটা হয়ে গেছে। এটা একটা ভাল চিহ্ন। ওরকম ট্রিপল পাইন খুব কম দেখা যায়। তারপর সে পেরোল একটা চ্যাপ্টা পাথর, মাঝখানটা। গামলার মত, বেশ বড়। আদিম ইণ্ডিয়ানরা সম্ভবত পাথর দিয়ে ওখানে কোন ধরনের বাদাম গুড়ো করে আটা তৈরি করত। আরও কিছু চিহ্ন মনে গেঁথে রাখল। সে। অবশেষে খুঁজে পেল পথটা। দেখেটেখে মনে হল জানোয়ারই চলাচল করে। সেই পথ ধরে এগোল সে। কানে আসছে পানির শব্দ, বাড়ছে ক্রমেই।
তারপর হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটা, বিশ ফুট চওড়া অগভীর একটা নদী। পানিতে বড় বড় পাথর আর ডালপালার ছড়াছড়ি, নদীর বুকে বিছিয়ে রয়েছে নুড়ি। যেখানটায় রোদ পড়ছে চকচক করছে পানি, আর বনের ভেতর দিয়ে যেখানে গেছে, গাছপালার ছায়া পড়েছে, কালো হয়ে আছে সেখানে। টলটলে পরিষ্কার পানি, নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় মনে হয়।
বায়োডিগ্রেডেবল সাবান দিয়ে কমলার রসের বোতলটা ভালমত ধুয়ে নিল রবিন। ঝাড়া দিয়ে ভেতরের পানির কণা যতটা সম্ভব ফেলে দিয়ে পরে রোদে শুকিয়ে নিল। পানি ভরে তাতে আয়োডিন পিল ফেলে দিল।
উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়ী নদীর এপাশ ওপাশ ভাল করে দেখতে লাগল সে। লোকজন কি আছে? ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকলে নদীর পাড়েই কোথাও আছে। কোথায়? উজানে, না ভাটিতে?
বিমান থেকে দেখা উপত্যকাটার কথা ভাবল সে। তৃণভূমির পশ্চিমেই কোথাও রয়েছে। ওর অনুমান ঠিক হলে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উত্তরে থাকবে উপত্যকাটা। এত সুন্দর একটা জায়গায় ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকাটা স্বাভাবিক।
উজানের দিকে রওনা হল রবিন। নদীর তীর ধরে। বড় পাথর আর গাছপালা পড়ছে মাঝে মাঝেই, ঘুরে ওগুলো পার হয়ে আসছে। কোথাও কোথাও জন্মে আছে কাটাঝোপ, কোথাও বা জলজ উদ্ভিদ পানি থেকে উঠে এসেছে পাড়ের ভেজা মাটিতে। যতই এগোচ্ছে পানির শব্দ বাড়ছে।
কয়েকটা লাল ম্যানজানিটা গাছ জটলা করে জন্মে রয়েছে এক জায়গায়, সেটার পাশ ঘুরে একটুকরো খোলা জায়গায় বেরোল সে। নদীতে এখানে তীব্র স্রোত। ওপর থেকে অনেকটা জলপ্রপাতের মত ঝরে পড়ছে পানি।
অপরূপ দৃশ্য। কোটি কোটি মৌমাছির মিলিত গুঞ্জন তুলে পড়ছে পানি, অসংখ্য ঘূর্ণিপাক তৈরি করে ছুটে চলেছে ভাটির দিকে।
বাতাসে পানির কণা। ভেজা বাতাসে শ্বাস নিতে হচ্ছে রবিনকে। জলপ্রপাত থেকে ধীরে ধীরে ওপর দিকে দৃষ্টি ভুলতে লাগল সে। নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রপাতের দুদিক থেকে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের চূড়া। কঠিন পাথরে গভীর নালা কেটে দিয়েছে পানি।
বিমান থেকে দেখা প্রপাতটা যদি এটাই হয়, তাহলে উপত্যকাটা রয়েছে। পাহাড়ের ওই পাশেই। দেখতে হলে ওই পাহাড়ে চড়তে হবে, পাথরের দেয়াল বেয়ে। প্রশ্ন হলো, কোনখান থেকে শুরু করবে?
গ্র্যানিটের দেয়ালে একটা জায়গা দেখা গেল, যেখানে পাথরে চিড় ধরে আছে, পা রাখা যাবে ওখানটায়। পানির বোতলটা রেখে, পাথরের একটা স্তূপ পেরিয়ে চিড়টার কাছে চলে এল সে। উঠতে শুরু করল দেয়াল বেয়ে। পা লাগলেই খসে যাচ্ছে আলগা পাথর, ঠোকর খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে নিচে। পা ফসকালে রবিনকেও ওভাবেই পড়তে হবে, কাজেই সাবধান রইল। খুব ধীরে, দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড় ধরে, পাথরের খাঁজে পা রেখেই উঠে চলল সে।
হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা।
ওপর থেকে কয়েকটা ছোট ছোট নুড়ি এসে পড়ল তার মাথায়। গুমগুম শব্দ কানে এল।
ওপরে তাকাল সে। বিশাল এক পাথর নেমে আসছে, সঙ্গে নিয়ে আসছে ছোট বড় আরও একগাদা পাথর, মাটি, ধুলো, ওর সামান্য ডানে।
ধস নেমেছে পাহাড়ে! ধেয়ে আসছে তাকে থেঁতলে দেয়ার জন্যে।
০৪.
গতি বাড়ছে ধসের। পিছানর উপায় নেই, আতঙ্ক চেপে ধরল যেন রবিনকে। ধসের পথেই রয়েছে। জলদি সরে যেতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু। ভাবনারও সময় নেই।