প্রথমে দেখা দরকার, কি কি জিনিস আছে আমাদের কাছে। আমার কাছে আছে গায়ের এই পোশাক।
মুসার পরনে জিনস, পায়ে টেনিস শু, গায়ে কালো টি-শার্ট, বুকে সোনালি অক্ষরে বড় বড় করে লেখাঃ পিঙ্ক ফ্লয়েড। একটা জ্যাকেট আছে, একটা ছোট ছুরি আছে, সুটকেসে আরও কিছু কাপড় আছে। রবিন আর কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাছে কি আছে?
আমার কাছেও এইই, রবিন বলল। ওর জিনসে রয়েছে ক্যালভিন ক্লেইন, আর টি-শার্টে ব্যানানা রিপাবলিক মিনিস্টার অভ কালচার-এর মনোগ্রাম। ছুরিটা বাদ।
আমার কাছেও ছুরি নেই, মিলফোর্ড বললেন। তার পরনে জিনসের প্যান্ট আর শার্ট, মাথায় ক্যাপ।
ক্যাম্পিঙের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ একটা ব্যাকপ্যাক থাকলে এখন খুবই ভাল হত, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। তবে মনে হয় তিনটে দিন কাটিয়ে দিতে পারব কোনমতে। প্রতিকূল পরিবেশ, খাওয়াও তেমন জুটবে বলে মনে হয় না, তবু…
তেমন জুটবে, না মানে? কথাটা ধরল রবিন। তার মানে কিছু খাবার তোমার কাছে আছে?
মাথা নাড়ল কিশোর, না, খাবার আমার কাছে নেই, তবে…
তবে কি? তর সইছে না মুসার। জলদি বল!
যে ভাবে বলছ, কিশোর বলল, ধরেই নিয়েছ, খাবার আছে আমার কাছে।
না হলে বললে কেন?
হ্যাঁ, বাবাআ, মিলফোর্ডও অধৈর্য হয়ে উঠছেন, থাকলে বের কর না!
শ্রাগ করল কিশোর। আসছি, বলে গিয়ে ঢুকে পড়ল বিমানের ভেতরে।
এত দেরি কেন? বাইরে থেকে ডেকে বলল মুসা, মাইক্রোওয়েভে খাবার তৈরি করছ নাকি?
একটা ডাফেল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। টকটকে লালের ওপর সাদা সাদা ডোরা। চট করে চোখে পড়বার জন্যে বেশ কায়দা করে লেখা রয়েছেঃ আই কেম ফ্রম, পিজা হ্যাঁভেন, ই। কাগজে মোড়া কিছু হালকা খাবার আর ক্যাণ্ডি বের করল সে।
দাও দাও, জলদি দাও! হাত বাড়াল মুসা। আর পারি না…
খাবারগুলো ভাগাভাগি করে নিল ওরা। সাধারণ জিনিস, এখন সেগুলোই রাজকীয় মনে হলো।
এগুলো আনতে গেলে কেন? ক্যাণ্ডিতে কামড় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন।
মনে করলাম, কিশোরের জবাব, প্লেনে যদি খিদে লাগে। নিয়ে নিলাম।
খুব ভাল করেছ, মুসা বলল। জীবনে যে কটা সত্যিকারের ভাল কাজ করেছ, তার মধ্যে এটা একটা।
তার কথার ধরনে হাসলেন মিলফোর্ড। হ্যাঁ, বি থাকলে বুদ্ধিটাও খোলে।
সেটা খোলানর জন্যেই যেন খাওয়া শেষ করার পর বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ মুদে ভাবতে শুরু করল কিশোর।
নিজের ভাগের খাবার চেটেপুটে খেয়ে মিলফোর্ড বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, কিশোর। খাবার যা বাকি আছে, যত্ন করে রেখে দাও। তিনদিন ধরে অল্প অল্প। করে খেতে হবে। বলা যায় না, তিনদিনের বেশিও থাকতে হতে পারে আমাদের।
ওঠা যাক এবার, মুসা বলল। বসে থাকলে হবে না। ঘুরে দেখে আসা। দরকার, আশেপাশে ঘরবাড়ি, আছে কি-না। রেঞ্জারের কেবিন থাকতে পারে। কিংবা ক্যাম্পগ্রাউণ্ড, কিংবা রাস্তা। পানিও লাগবে আমাদের। লাকড়ি কুড়ানোর সময় পানির শব্দ শুনছিলাম। কাছেই কোথাও ঝর্না আছে। হাত তুলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দেখাল সে। ঝর্নার ধারেই করা হয় ক্যাম্পগ্রাউণ্ডগুলো, কাজেই…
..থাকলে ওদিকটায় থাকতে পারে, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। বিমানের ভেতর থেকে দুই কোয়ার্টের একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করে এনে মুসাকে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও। পানি আনতে পারবে।
কমলার রস ছিল বোতলটায়, এখন খালি। আগ্রহের সঙ্গে সেটা হাতে নিয়ে মুসা বলল, গুড। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ওটা, ফুটোটুটো আছে কিনা। নেই। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও। সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে তারপর পানি ভরবে। আয়োডিন পিল ফেলে দেবে ভেতরে, যাতে নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়।
বোতলটা নিল রবিন। তুমি কি করবে?
দক্ষিণে হাত তুলল আবার মুসা। ওদিকে বনের ভেতরে একটা পায়েচলা পথ। ঢুকে গেছে দেখেছি। বুনো জানোয়ার চলার পথ হতে পারে। বলা যায় না, কপাল। খুলেও যেতে পারে। হয়ত মানুষেই তৈরি করেছে ওটা।
ভাল বলেছ, মিলফোর্ড বললেন। যাও, দেখ গিয়ে। আমি ওটাতে চড়ব। তৃণভূমির উত্তর ধার দিয়ে চলে যাওয়া গ্র্যানিটের দেয়ালটা দেখলেন তিনি। একপাশে বেশ ঢালু, চূড়ায় চড়া সহজ। ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। কি আছে না আছে দেখতে পারব।
পারবে? রবিন বলল, ভাল লাগছে কিছুটা?
পারব।
কিশোর কি করবে সেটা জানার জন্যে তার দিকে তাকাল তিনজনে।
প্রশ্ন করতে হলো না, কিশোর নিজে নিজেই বলল, আ-আমার মনে হয়…আমার এখানে থাকাই ভাল। কেউ যদি চলে আসে, তাকে বলতে হবে তো আমরা আছি এখানে, চলে যাইনি।
আরও লাকড়ি দরকার আমাদের, মুসা বলল। ভেজা লাকড়ি। বেশি করে জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে অনেক ধোয়া বেরোবে। সঙ্কেত দিতে পারব। স্মোক সিগন্যাল। এই কাজটা তুমি করতে পার, প্লেনের কাছ থেকে দূরে যাওয়া লাগবে না। আরও একটা কাজ, আমাদের সবার সুটকেস থেকেই কিছু কাপড় বের করে তিন-চারটা গাছের মগডালে পতাকার মত উড়িয়ে দিতে পার। আরেক ধরনের সিগন্যাল হয়ে যাবে।
মুসার কথা কিশোর শুনছে বলে মনে হলো না, বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে শূন্য দৃষ্টিতে কাজ করার ইচ্ছে নেই, না গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে, বোঝা গেল না। মুসা বলেই চলেছে, তারপর, পাথর টেনে মাঠের মাঝে সেগুলো সাজিয়ে এস ও এস লিখবে, যাতে ওপর থেকে কোন প্লেনের চোখে পড়লে বুঝতে পারে এখানে গোলমাল হয়েছে।