অনেক দূরে চলে গেছে বিমানটা। ছোট হয়ে এসেছে, মিলিয়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল রবিন। অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন। পরিস্থিতি খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বাবা এমন সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, হতাশা অনেকটাই কেটে গেছে ওর। আশা হচ্ছে এখন, ওদেরকে উদ্ধার করতে আসবেই কেউ না কেউ। মুসার হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি ওটা?
ইমারজেন্সি কিট। অনেক জঞ্জালের ভেতর থেকে বের করেছি। দেখো না, কি ধুলো লেগে আছে।
হু।
বাক্সটা খোলা হলো। ভেতরে রয়েছে অ্যাসপিরিন, বায়োডিগ্রেডেবল সোপ, ব্যাণ্ডেজ, মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্কিন অ্যানটিবায়োটিক, পানি পরিশোধিত করার আয়োডিন পিল, এক বাক্স দিয়াশলাই, আর ছয়টা হালকা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট। চকচকে এক ধরনের জিনিস দিয়ে এত পাতলা করে বানানো, ভাঁজ করে নিলে খুব অল্প জায়গার ভেতরে ভরে রাখা যায়।
দিয়াশলাই! খুশি হয়ে উঠেছে রবিন, যাক, আগুনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
আয়োডিন পিল আছে যখন, মিলফোর্ড বললেন, খাবার পানিও পেয়ে যাব।
এগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে মহাকাশচারীদের কাজে লাগে, একটা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট খুলল মুসা। একটা ধার ঢুকিয়ে দিল টি-শার্টের গলা দিয়ে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়? রক স্টারের মত লাগছে?
জবাব দিল না রবিন। ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার কপালের জখমটায় পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাধল। কাটাটা খুব বেশি না, তবে বাড়িটা লেগেছে বেশ জোরেই। অনেকখানি উঁচু হয়ে ফুলে গেছে। বেগুনী রঙ।
ফোলা মাংসে আঙুল দিয়ে চাপ দিল রবিন। উহ করে উঠলেন মিলফোর্ড। বেশি ব্যথা লাগছে? জিজ্ঞেস করল রবিন। বেশি খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ো। মাথায় বাড়ি লাগা ভাল না! বমি বমি লাগছে? মাথা ঘোরে…
একেবারে ডাক্তার হয়ে গেলি যে রে! হেসে বললেন মিলফোর্ড। রেড ক্রসের ট্রেনিং নিয়ে ভালই হয়েছে…।
আমারও তাই বিশ্বাস। এখন চুপ কর তো! খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।
ব্ল্যাঙ্কেটটা আবার আগের মত ভাজ করে রেখে দিল মুসা। তারপর রওনা। হলো তৃণভূমির কিনারে, আগুন জ্বালানোর জন্যে লাকড়ি জোগাড় করতে। প্রথমে। যেখানটায় আশ্রয় নিয়েছিল, বিমান বিস্ফোরিত হলে আত্মরক্ষার জন্যে, সেখানটায় এসে জড় করল কাঠকুটো। আগুন যদি জ্বালতেই হয়, জ্বালবে বিমান আর ট্যাঙ্কের পেট্রোল থেকে দূরে। সাবধান থাকা ভাল।
সেসনার ভেতরে রয়েছে এখনও কিশোর। একটা পানির পাত্র খুঁজছে। আচমকা চিৎকার উঠল, অ্যাই, শুনছ তোমরা, একটা গোলমাল হয়ে গেল!
বিমানের কাছে দৌড়ে এল মুসা আর রবিন। ওদের পেছনে এলেন মিলফোর্ড।
যন্ত্রটা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর, কাজ করছে না। মে-ডে পাঠানোর কথা যেটার।
কেন? জানতে চাইলেন মিলফোর্ড।
বাক্সটা খুলল কিশোর। লাল একটা আলো জ্বলে-নিভে সঙ্কেত দেয়ার কথা। ওটা দেখে বোঝা যায় যে, সঙ্কেত দিচ্ছে যন্ত্রটা। তারটার আর কানেকশনগুলো। ঠিকই আছে। গোলমালটা ব্যাটারির। মনে হয় ডেড।
ডেড? হতাশার ভঙ্গিতে প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন।
তার মানে সাহায্য চেয়ে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না? মুসাও খুব হতাশ। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।
ব্যাটারি না থাকলে পাঠাবে কি করে? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল কিশোর।
খাইছে! হাতের আঙুলগুলো মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল মুসার। বেড়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের গতি, অ্যাড্রেনালিন পাম্প করতে আরম্ভ করেছে। কি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে।
প্রথমে গেল ইলেকট্রিক সিসটেম, আনমনে মাথা নাড়ছে রবিন, এখন ব্যাটারি! অসুস্থই বোধ করছে সে।
গেলাম তাহলে আমরা! মুসা বলল।
ইলেকট্রিক্যাল সিসটেম মাঝে মাঝে খারাপ হয়, মিলফোর্ড বললেন, যদিও খুব রেয়ার। কানেকশনে গোলমাল থাকলে হয়। তবে ব্যাটারি খারাপ হয় না, ফুরিয়ে যায়। বদলে নিলেই হয়। আসলে, চেক করেনি, নতুন ব্যাটারিও আর লাগায়নি। ভুলের জন্যেই এটা ঘটল।
আর এই ভুলের কারণেই মরতে বসেছি আমরা, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা।
কিন্তু কিছু করার নেই। পাইনের বন থেকে শিস কেটে বেরিয়ে আসছে বাতাস, বয়ে যাচ্ছে বিশাল ঘেসো প্রান্তরের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। ওদের পেছনে ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশে মাথা তুলে রেখেছে পর্বতের চূড়া।
বেহশত, আবার আনমনে মাথা নাড়তে লাগল রবিন সেদিকে তাকিয়ে।
দেখেই মজে যাওয়ার কোন কারণ নেই, সাবধান করলেন মিলফোর্ড। শোননি, স্বর্গেও সাপ থাকে।
আমি মজিনি, কিশোর বলল। এখানে কি কি থাকতে পারে, ভাল করেই জানি। বিষাক্ত সাপ, হিংস্র মাংসাশী জানোয়ার, ভূমিধস, দাবানল, বজ্রপাত, আর আরও হাজারটা বিপদ ওত পেতে আছে। ফল ধরে থাকতে দেখা যাবে গাছে গাছে, দেখলেই খেতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু খেলেই মরতে হবে, এতই বিষাক্ত।
আচ্ছা, হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল রবিন, বাবা, ডায়মণ্ড লেকে যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ, সে কি করবে? সময়মত তুমি না পৌঁছলে কিছু করবে না?
হয়তো করবে। ফোন করবে আমার অফিসে। ও না করলে আর কেউ করবে না। বাড়িতে বলে এসেছি আমরা সবাই, দিন তিনেক লাগতে পারে। তিন। দিন না গেলে কেউ খবর নেয়ার কথা ভাববেই না।
বাহ, চমৎকার! বিড়বিড় করল মুসা।
মুসা, অত ভেঙে পড়ছ কেন? এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক পড়েছ তোমরা। দুর্গম জায়গায় আটকা পড়েছ, বেঁচে ফিরেও এসেছ। এসব অবস্থায় প্রথমে কি করা উচিত?