জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে রবিন বলল, গেছে!
নামতে যে পেরেছি, এটাই বেশি, মুসা বলল।
কিশোর বলল, হ্যাঁ, অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম, জীবনটা এখানেই খোয়াতে হবে। অথচ একটা হাডিডও ভাঙল না, আশ্চর্য!
আমার ক্যাপটা কোথায়? মিলফোর্ড বললেন। ছেলেদের বাধা দেয়ার তোয়াক্কা করলেন না আর, পাথরের একটা ধার খামচে ধরে টেনে তুললেন শরীরটাকে।
বাবা!
আঙ্কেল!
পাথরে হেলান দিলেন মিলফোর্ড। সোজা রাখলেন মাথাটা। তিক্ত হাসি ফুটল ঠোঁটে। মাথায় সামান্য ব্যথা, আর কোন অসুবিধে নেই।
বসে পড়ো! রবিন বলল।
উপায় নেই, মিলফোর্ড বললেন। প্লেনটার অবস্থা দেখতে হবে।
কিন্তু ইঞ্জিন গরম…
মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, আগুন লাগার ভয় করছ? এখনও যখন লাগেনি, আর লাগবে না। বিমানটার দিকে তাকালেন। এক পা বাড়ালেন সামনে, তারপর আরেক পা। নাহ, পারছি হাঁটতে। পারব। অতটা খারাপ না। টলে উঠলেন তিনি।
খপ করে এক হাত ধরে ফেলল রবিন। মুসা ধরল আরেক হাত।
বড় বেশি গোয়ার্তুমি করো তুমি, বাবা!
তোর মা-ও একই কথা বলে, হেসে বললেন মিলফোর্ড। আমাদের এডিটর সাহেবও। সব সময়ই বলেন। আবার পা বাড়ালেন তিনি। তবে ছেলেদের সাহায্য নিতে অমত করলেন না।
পাশে পাশে চলল কিশোর। বিমানের কাছে পৌঁছে পাইলটের সীট থেকে বাবার সানগ্লাস আর ক্যাপটা তুলে নিল রবিন।
এ নীল উইণ্ডব্রেকারের পকেটে চশমাটা রেখে দিলেন মিলফোর্ড। ক্যাপটা মাথায়। দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিকমত বসার চেষ্টা করলেন, যাতে কপালে না লাগে। বসিয়ে, হাসলেন। যেন বোঝাতে চাইলেন, আমাকে অত অসহায় ভাবছ কেন? আমি এখনও সবই পারি।
আশপাশটায় চোখ বোলাল ওরা। পাহাড়ের ঢালে ঢালু হয়ে নেমে গেছে তৃণভূমি। তার পরে ঘন বন। তিন পাশেই, বেশ কিছুটা দূরে মাথা তুলেছে গ্র্যানিটের পাহাড়। রোদে চকচক করছে। পেছনে প্রায় দুশো ফুট উঁচু আরেকটা পাহাড়, দুই প্রান্তই ঢালু হয়ে গিয়ে ঢুকেছে পাইন বনের ভেতরে। উত্তরের পাহাড় চূড়ার জন্যে দেখা যাচ্ছে না তার ওপাশে কি আছে।
লোকালয়ে কোন চিহ্নই চোখে পড়ল না। ডায়মণ্ড লেক এখান থেকে কম করে হলেও তিরিশ-চল্লিশ মাইল দূরে হবে। উত্তরের চূড়াটা না থাকলে হয়তো চোখে পড়ত। তবে আকাশ থেকে নিচের জিনিস যতটা ভালভাবে দেখা যায়, নিচে থেকে যায় না।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে রবিন নিচের তরাই অঞ্চল। অন্য কোন সময় হলে, অর্থাৎ পরিস্থিতি ভাল থাকলে জায়গাকে খুব সুন্দর বলত সে। চোখা হয়ে উঠে যাওয়া চূড়া, নিচের সবুজ উপত্যকা, ঘন বন। এখন সে সব উপভোগ করার সময়। নেই। একটা কথাই বার বার পীড়িত করছে মনকে, ওরা এখানে একা। নির্জন এক পার্বত্য এলাকায় নামতে বাধ্য হয়েছে ওরা। সাথে খাবার নেই, পানি নেই। রেডিও, ক্যাম্প করার সরঞ্জাম কিছুই নেই। বাঁচবে কি করে?
যেন তার মনের কথাটাই পড়তে পেরে ক্লান্ত স্বরে মিলফোর্ড বললেন, শোনো। তোমরা, এসব বুনো এলাকায় কি করে বেঁচে থাকতে হয় জানা আছে তো?
.
০৩.
কতটা বেশি ঠাণ্ডা পড়বে এখানে? বাবাকে জিজ্ঞেস করল রবিন।
উষ্ণ রোদে আরাম করে বসে আছ দুজনে। কিশোর আর মুসা পানি রাখার জন্যে একটা পাত্র পাওয়া জায় কি-না খুঁজে দেখতে গেছে বিমানের ভেতরে। মেডিক্যাল কিটও দরকার।
আবহাওয়া এখন ততটা খারাপ হবে না, মিলফোর্ড বললেন। আগস্ট মাস তো, ঠাণ্ডায় জমে মরার ভয় নেই। রাতে তাপমাত্রা চল্লিশের নিচে নামবে বলে মনে হয় না।
চল্লিশ! ভুরু ওপর দিকে উঠে গেল রবিনের। ঠাণ্ডাই তো!
তা একরকম ধরতে পারো, হাসলেন মিলফোর্ড। হাজার হোক ক্যালিফোর্নিয়া…
হ্যাঁ, ক্যালিফোর্নিয়া তো বটেই, মুসা বলল। বিমানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এগোনোর সময় মিলফোর্ডের কথা কানে গেছে তার। যত সব গণ্ডগোলের আখড়া। আবহাওয়ার কোন ঠিকঠিকানা নেই। মুসার হাতে একটা ধাতব বাক্স।
শীত সহ্য করার মত শরীর নয় আমাদের, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল রবিন সে-ই জানে।
মুসার পেট গুড়গুড় করে উঠল। ক্ষুধা সহ্য করার মতও নয়। ভাবছিলাম, ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে পেট পুরে ভেড়ার কাবাব খাব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত নাড়ল সে। গেল সব!
একমত হয়ে মাথা জাঁকালেন ফিলফোর্ড আর রবিন। খিদে তাঁদেরও পেয়েছে।
ডায়েট কন্ট্রোল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আপাতত, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন।
দেখো, কিশোর কি বলে? করুণ হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। কিছু একটা আবিষ্কার করেই ফেলবে–মনে নেই, প্রশান্ত মহাসাগরের মরুদ্বীপে…
হ্যাঁ, তা তো আছেই। পিঁপড়ের ডিম আর শুয়াপোকা খাওয়াবে আর কি শেষে… বিমান দুর্ঘটনা।
বাধা দিয়ে মিলফোর্ড বললেন, অতটা নিরাশ হচ্ছ কেন? বেরিয়ে যাওয়ার একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। আমাদের মে-ডে কারও কানে যেতেও পারে। ওয়ান টোয়েন্টি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ মেগাহার্টজে এখন ব্রডকাস্ট চলছে।
আপনি শিওর? ভরসা করতে পারছে না মুসা। সত্যিই চলছে রেডিওটা?
চলার তো কথা। ব্যাটারিতে চলে। জোরে ধাক্কা কিংবা বাড়ি খেলেই আপনাআপনি চালু হয়ে যায়। এমনও শোনা গেছে, হাত থেকে টেবিলের ওপর। পড়ে গেলেও চালু হয়ে যায়।
নীল আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। অনেক ওপরে ধোয়ার হালকা একটা সাদা রেখা চোখে পড়ছে। একটা জেট বিমান যাওয়ার চিহ্ন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিলফোর্ড বললেন, ওখান থেকে আমাদেরকে দেখতে পাবে না, ঠিক, তবে আমাদের এস ও এস শুনতে বাধা নেই।