হালকাপাতলা লোকটার কথা মনে পড়ল কিশোরের, যে মালটিকে ইশারা করেছিল পিকআপ রেডি হয়েছে জানিয়ে। জিজ্ঞেস করল, নিওমো মোড়লের সহকারী, তাই না?
সব সময় না, জন বলল। মাঝে মাঝে কাজে সাহায্য করে। দুজনের। হাতেই ওয়াকি-টকি আছে। রাইফেল আছে! মোড়লচাচার হাতে রাইফেল থাকাটা মারাত্মক। নিশানা বড় সাংঘাতিক!
রাগার টেন বাই টোয়েন্টি টু হান্টিং রাইফেল! বিড়বিড় করল কিশোর। আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছে প্রায়। এতগুলো লোক আর শক্তিশালী অস্ত্রের মুখ থেকে বেঁচে বেরোবে কি করে?
মালটি বলেছে, তোমাদের মোড়ল নাকি গাঁয়ের জন্য নানা রকম জিনিস কিনে নিয়ে আসে, রবিন বলল। মোটর ইঞ্জিনের পার্টসের মত দামি জিনিসও আনে। তার একটা নতুন গাড়ি দেখেছি, অনেক দামি। এখন বোঝা যাচ্ছে। জোনসের কাছ থেকে ভাল টাকা পায় সে, মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।
কালো হয়ে গেছে জনের মুখ। বিশ্বাসই করতে পারছি না! এত ভাল একজন মানুষ…
গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।
এই ভাল মানুষদের নিয়েই সমস্যা, মিলফোর্ড বললেন। দেখে মনেই হয় না। এরা খারাপ কিছু করতে পারে। মোড়লকে ফাঁসানোর মত কোন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। নিওমোকে ধরার মতও নেই।
তাহলে কে আমাদের ব্রেক নষ্ট করে দিয়ে মেরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই? রেগে গিয়ে বলল মুসা।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল জন। তারপর ঘুরে তাকাল আরেক দিকে, জানি না। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মোড়ল কিংবা নিওমো এরকম কাজ করতে পারে।
ওসব আলোচনার অনেক সময় পাব, আবার ড্রাইভারের সীটের দিকে রওনা হলো কিশোর। এখন একটাই কাজ, বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।
একটা ঝাড়ু রাখার আলমারি দেখিয়ে নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করল মুসা, ওর মধ্যে বন্দুক-টক আছে?
থাকলেও লাভ নেই, মিলফোর্ড বললেন, এম সিক্সটিনের বিরুদ্ধে বন্দুক দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়া ওখানে কিছু রেখেছে বলেও মনে হয় না। অন্য উপায় করতে হবে আমাদের।
ড্যাশবোর্ডের নিচে হাতড়াচ্ছে কিশোর। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে। মাথায়। মেরিচাচী প্রায়ই বলেনঃ সব রকম বিপদের জন্যে সব সময় তৈরি থাকলে মানুষের বিপদ অনেকটাই কমে যায়। কিশোরও মানে সেকথা। জোনসকে দেখে যা মনে হয়েছে, অনেকটাই মেরিচাচীর স্বভাব। সব কিছুর জন্যেই যেন তৈরি থাকে সব সময়। এই গাড়িটাকে যখন অফিস বানিয়েছে, অনেক কিছুর জন্যই তৈরি করে রেখেছে:হ্যাঁ, এই তো, যা ভেবেছিল। পেয়ে গেল জিনিসটা। হাতটা ড্যাশবোর্ডের নিচ থেকে বের করে এনে মুঠো খুলল। ছোট একটা ম্যাগনেটিক কেস, যার মধ্যে লোকে গাড়ির বাড়তি চাবি রাখে, একটা হারিয়ে গেলেও যাতে প্রয়োজনের সময় দ্বিতীয়টা পেয়ে যায়।
গাড়ির ভেতরের উত্তেজনা মুহূর্তের জন্যে সহজ হলো। হাসি-মুখে চাবিটা মুসার হাতে তুলে দিল কিশোর। প্রায় লাফ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা।
মুসা, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিলফোর্ড, তোমাকে যে রাস্তা দিয়ে এনেছে ডক, সেই রাস্তা দিয়েই চলে যাও। গুলি করে টায়ার ফাটিয়ে দিলেও থামবে না, বসা টায়ার নিয়েই চালাবে। মোট কথা, কোন কারণেই থামবে না। তোমার একমাত্র লক্ষ্য হবে, চালিয়ে যাওয়া। ডায়মণ্ড লেকে যাব আমরা!
বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সহজে ভয় পান না তার বাবা। এখন পেয়েছেন। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
মুসা বলল, সবাই মাথা নামিয়ে রাখো। শক্ত করে ধরে থাকো কিছু।
মেঝেতেই শুয়ে পড়ল সকলে, মিলফোর্ড সহ। জন সতর্ক, সাংঘাতিক সতর্ক, গভীর দুর্গম বনে চলার সময় যেমন থাকে। রবিন ভাবছে, রকি বীচে আর কি কোনদিন ফিরে যেতে পারবে? যেতে পারবে ট্যালেন্ট এজেন্সি কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে? বার দুই ঢোক গিলল কিশোর। মনে মনে বলছে, খোদা, এবার যেন। ফোর্ড পিকআপটায় চড়ার মত দুর্গতি না হয়।
আর মুসা, ভারি একটা দম নিয়ে আস্তে মোচড় দিল ইগনিশনে। জেগে গেল ইঞ্জিন।
.
১৬.
স্টিয়ারিঙের ওপর ঝুঁকে রয়েছে মুসা। যতটা সম্ভব গুলির নিশানা থেকে সরে থাকতে চাইছে। কয়েকটা মোচড় দিয়েই গাড়ির নাক ঘুরিয়ে ফেলল, ছুটল খোলা জায়গাটার দিকে। জোনসের চওড়া মুখে বিস্ময় দেখতে পেল সে।
তারপরই ছুটে আসতে লাগল বুলেট। বিধতে লাগল গাড়ির শরীরে। একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
এই, সবাই ঠিক আছ? চিত্তার করে জিজ্ঞেস করল মুসা।
আছি! চারটা কণ্ঠই জবাব দিল।
আরও একঝাঁক বুলেট এসে বিধল গাড়ির শরীরে। আরেক ঝাঁক ধুলো ওড়াল রাস্তায় লেগে। মাটির কণা লাফিয়ে উঠল। চাকা ফুটো করতে চাইছে।
বার্চ আর পাইন বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে সরু রাস্তাটা, সেটা ধরে ছুটেছে মুসা।
জোনসের পাশে এসে দাঁড়ালেন গভীর চেহারার মোড়ল, উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। হাত তুলে গুলি থামানর নির্দেশ দিল জোনস। বেল্ট থেকে ওয়াকি-টকি খুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।
পাশ দিয়ে গাড়িটা ছুটে বেরোনর সময় এদিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল সে, রাগ দেখানর পরিবর্তে একটা হাসি দিল। রহস্যময়, শয়তানি হাসি। কারণটা বুঝতে পারল না মুসা। ওরা পালিয়ে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। তাহলে হাসল কেন লোকটা?
আমাদেরকে কিছু করছে না ওরা! চেঁচিয়ে সঙ্গীদেরকে জানাল মুসা।
আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে তীব্র গতিতে চলেছে গাড়ি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরে রেখেছে মুসা। গতিবেগ আর বাড়ানোর সাহস করতে পারছে না। রাস্তায় একটু পর পরই বাঁক, বিশ-পঁচিশ গজের বেশি দেখা যায় না মোড়ের জনে) রাস্তাও খারাপ। এপাশ ওপাশ ভীষণ দুলছে গাড়ি। গাছের ডালে ঘষা লাগছে।