ঢালের ওপরেই রয়েছে ওরা, তবে এত কম ঢালু, অন্য প্রান্তের দিকে না, তাকালে বোঝাই যায় না। ওপাশটা এখান থেকে উঁচুতে। পাহাড়ের পাথুরে দেয়াল জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে অগণিত ধসের ঘষায়।
এখন তো মনে হচ্ছে, আমাদের প্লেন অ্যাক্সিডেন্টটাও অ্যাক্সিডেন্ট নয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, ঘটানো হয়েছে। পকেট থেকে একটা ক্যাণ্ডি বের করে খেতে লাগল সে।
তা কি করে হয়? পানি খাওয়ার জন্যে বোতলের মুখ খুলল রবিন।
তা-ই হয়েছে। প্রথমে ইলেকট্রিক সিসটেম নষ্ট হয়ে গেল, ক্যাণ্ডি চিবাতে চিবাতে বলল কিশোর। নামতে বাধ্য হলাম আমরা। তোমার বাবাকে কিডন্যাপ করার জন্যে তৈরি হয়ে ছিল ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস।
তাই তো! চোখ বড় বড় করে ফেলল রবিন। তার মানে স্যাবোটাজ করা হয়েছে প্লেনটাকে?
হ্যাঁ। জোনস কিংবা তার কোন সহকারী করেছে কাজটা।
নীরবে খেল কিছুক্ষণ দুজনে। তারপর রবিন জিজ্ঞেস করল, এখন কি করা? বাবাকে বের করতেই হবে।
আপাতত হাঁটতে হবে আমাদের। আমার বিশ্বাস, উপত্যকাটা উত্তর-দক্ষিণে ছড়ানো। তার মানে কাঠ পারাপারের রাস্তাটা রয়েছে সামনে। গেলে হয়তো মুসার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে আমাদের। কিংবা ফরেস্ট সার্ভিসের সঙ্গে।
তা ঠিক। এদিক দিয়ে গেলে অবশ্য আরেকটা সুবিধে, জোনস আমাদের পিছু নিতে পারবে না। দেয়াল ডিঙানোর সাহস নেই ওর।
আরেকটা কাজ হতে পারে, যোগ করল কিশোর, হয়তো জানতে পারব কি কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে ইনডিয়ানরা।
খাওয়া শেষ করে ক্যাণ্ডির মোড়কগুলো পকেটে রেখে দিল ওরা। বুনো এলাকার প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করতে চায় না, যেমন আছে তেমনি থাক।
অন্ধকার হয়ে আছে উপত্যকা। ওপরে তারা ঝিলমিল করছে। ধীরে ধীরে পাহাড়ের কিনারে উঁকি দিল বিশাল চাঁদ।
পরিশ্রমে ভেঙে পড়ছে শরীর, কিন্তু বিশ্রামের উপায় নেই। চাঁদের আলোয়। পথ দেখে দেখে এগিয়ে চলল ওরা। নদীর ধার ধরে। সামনে বড় পাথর কিংবা ঝোপঝাড় পড়লে সেগুলো ঘুরে এসে আবার আগের রাস্তা ধরছে। আধ মাইল মত চলার পর একটা জলাভূমি পড়ল, সরে আসতে বাধ্য হলো ওরা, একদিকের দেয়ালের কাছে। জলাভূমি শেষ হয়ে গেছে কিছুটা এগিয়ে, আবার নদীর দিকে ঘুরতে গিয়েই বরফের মত জমে গেল যেন রবিন। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল স্থির হয়ে। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।
কি হয়েছে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নীরবে হাত তুলে দেখাল রবিন। ফুট বিশেক দূরে মাটিতে পড়ে জ্বলছে সাদা সাদা কি যেন।
কিশোরের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।
আমি যা ভাবছি তা-ই ভাবছ? তোতলাতে শুরু করল রবিন।
কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে এগোল ওরা। যতই কাছে এগোল আরও ভাল করে দেখতে পেল, সাদা জিনিস অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঘাস আর ঝোপের ভেতর থেকে ফুটে বোরোচ্ছে ফেকাসে আলো। বাতাস বয়ে গেলে ঘাসে ঢেউ জাগে, তাতে মনে হয় ভেতরের সাদা রঙটাই বোধহয় কাঁপছে।
আরেকটু এগিয়ে থামল দুজনে। থরথর করে কাঁপছে রবিন। কিশোরেরও কাঁপুনি শুরু হয়েছে, তবে সেটা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছে সে।
ওদের প্রায় পায়ের কাছেই পরে রয়েছে একচিলতে সাদা রঙ, দূর থেকে এটাকেই দেখেছিল।
দে-দেখ, কত লম্বা! কোনমতে বলল রবিন।
একটা টিবিয়া, হাড়টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বয়স্ক লোকের। ইনডিয়ানদের সমাধিতে চলে এসেছি আমরা।
দেখার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার! বিকৃত হয়ে গেছে রবিনের কণ্ঠ। ধসটস নেমে বোধহয় মাটির নিচ থেকে বের করে দিয়েছে হাড়গুলোকে। কতগুলো আছে, আন্দাজ করতে পারো? পাথর আর মাটির একটা বড় স্কুপের কাছে জড় হয়ে আছে হাড়গুলো, ধসটা নেমেছিল পাশের পাহাড় থেকে।
ওই আরেকটা ঢিবিয়া, কিশোর বলল। ওই যে ওটা ফিমার, ওগুলো পাজরের হাড়, ওটা মেরুদণ্ড ভাঙা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে হাড়গুলো। পুরো একটা কঙ্কালই বোধহয় রয়েছে এখানে।
ওই যে খুলিটা! গায়ে কাটা দিল রবিনের।
খুলির চোখের জায়গায় কালো কালো বড় দুটো গর্ত। ছোট কালো একটা তিনকোনা গর্ত, নাক ছিল যেখানটায়। হাঁ হয়ে আছে চোয়াল, দুই সারি দাঁত নীরব বিকট হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন।
দাঁড়াও তো দেখি! এগিয়ে গিয়ে ঝকঝকে একটা জিনিস তুলে নিল কিশোর। কোমরের বেল্টের রূপার একটা বাকস, মাঝখানে ইয়া বড় এক নীলকান্তমণি বসানো।
দেখেটেখে রবিন বলল, একেবারে জনেরটার মত দেখতে।
কঙ্কালটা তার হারিয়ে যাওয়া চাচারও হতে পারে, বাকলসটা পকেটে রেখে দিল কিশোর।
কিন্তু চাচা তো নিখোঁজ হয়েছে একমাস আগে। এত তাড়াতাড়ি হাড়ের এই দশা…
জানোয়ারে খেয়ে সাফ করে দিয়ে যেতে পারে।
খুলিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ভয়টা চলে গেছে। তার জায়গায়। ঠাই নিয়েছে বিষণ্ণতা। অসুস্থ বোধ করছে সে। এটা দেখো। গোল একটা ছিদ্র দেখাল সে।
বুলেটের ছিদ্র?,
হ্যাঁ। খুন করা হয়েছে লোকটাকে।
.
এগিয়ে চলেছে মুসা। ক্লান্ত হয়ে আসছে ক্রমেই। শেষে আর পারল না। খোলা রাস্তা থেকে সরে চলে এল বনের ভেতরে। স্পেস ব্লাংকেটটা বের করে গায়ে। জড়িয়ে শুয়ে পড়ল একটা পাইনের গোড়ায়। একটু পরেই কানে এল ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দ। এগিয়ে চলেছে ভুল দিকে, যেদিক থেকে সে এসেছে, পর্বতের দিকে। ওদিকে কেন? ডায়মণ্ড লেক তো ওদিকে নয়?