আবার একে অন্যের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। খুব চমকে গেছে। জোনসের লোকেরা খুন করেছে হেরিংকে!
না, একই কাজ করতে গেলে সন্দেহ করবে পুলিশ, জোনস বলল। ধরে নিয়ে গিয়ে প্লেনের ভেতরে ভরতে হবে সব কটাকে। ধাড়িটাকে সহ। তারপর দেবে আগুন লাগিয়ে। যাতে মনে হয় ল্যাণ্ড করার সময় পুড়ে মরেছে। আরেকটা অ্যাক্সিডেন্ট। কেউ ধরতে পারবে না।
তা পারবে না, প্রতিধ্বনি করল যেন ডক।
আগে ধর ওদের, জোনস বলল। ডক, তুমি চলে যাও। বিচ্ছুগুলোকে ধরতে সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আজ রাতে আরেকটা চালান আসবে। ওটা তুমি সামলাও গিয়ে।
আমি! হতাশ হয়েছে মনে হল ডক।
হ্যাঁ, তুমি। ছেলেগুলোকে ধরে আনব আমরা। তারপর ইচ্ছে হলে আগুন লাগানোর কাজটা তুমিই করো।
উজ্জ্বল হলো ডকের মুখ। ঠিক আছে। ঘুরে জোর কদমে নদীর দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
কিসের চালান? রবিনের প্রশ্ন।
হবে কোন কিছু, কিছু ভাবছে কিশোর, রবিনের কথায় মন নেই।
চলো, হিলারি, সঙ্গীকে বলল জোনস, এই প্রপাতের ওপাশে একটা উপত্যকা আছে। ওখানে লুকানোর কথা ভাবতে পারে ছেলেগুলো।
দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল সে।
হাসল হিলারি, বেরিয়ে পড়ল বেকাতেড়া কুৎসিত দাঁত। কাঁধে ঝোলানো এম-১৬টা একবার টেনেটুনে দেখে বসের পিছু নিল সে-ও। উঠতে আসতে লাগল রবিন আর কিশোর যেখানে লুকিয়েছে।
পাথর হয়ে গেল যেন দুই গোয়েন্দা। লোকগুলো উঠে এলেই দেখে ফেলবে ওদেরকে।
১৩.
সাবধানে বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে জোনস আর হিলারি। আগের দিন যে সিঁড়িটা দিয়ে উঠেছিল রবিন, সেটা দেখে ফেলল জোনস। ওঠা অনেক সহজ হয়ে গেল তার জন্যে।
হিলারির কাছে বোধহয় অতটা সহজ লাগছে না। ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
উঠে আসছে দুজনে। জানে না, ওদের মাথার ওপরেই লুকিয়ে রয়েছে যাদেরকে খুজছে।
কিশোর, এবার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।
এখনও হাত-পা কাঁপছে কিশোরের। তবে মগজটা ঠিকমতই কাজ করছে। বেরিয়ে থাকা একটা গাছের শেকড় ধরে টান দিল। কিছু হল না। আরও জোরে টানল। উঠে এল শেকড়, সাথে করে নিয়ে এল ধুলো, মাটি, পাথর।
ওপর দিকে তাকাল জোনস আর হিলারি। কয়েকটা পাথর গড়িয়ে গেল ওদের দিকে। সাথে করে নিয়ে নামতে লাগল আলগা পাথর আর মাটি। বাড়ি লেগে বড় পাথরও নড়ে উঠল। আরেকবার বাড়ি লাগতেই খসে গিয়ে ধসের সৃষ্টি করল।
তাড়াতাড়ি দুপাশে সরে গেল দুজন লোক।
ধসটা নেমে গেল ওদের মাঝখান দিয়ে।
বস… শুরু করতে যাচ্ছিল হিলারি, ওর গলা কাঁপছে। নিশ্চয় হাতও কাঁপছে।
হয়েছে, আর উঠতে হবে না, জোনস বলল। এখানে ওঠেনি ওরা। ওঠার উপায় নেই। যে হারে ধস নামে! নিশ্চয় বনের মধ্যে লুকিয়েছে। আজ রাতটা নদীর কিনারে কাটাব আমরা। কাল সকালে আবার খুঁজতে বেরোব।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আস্তে আস্তে ছেড়ে বুক খালি করল রবিন। তারপর বলল, বাঁচালে, কিশোর!
নেমে যাচ্ছে জোনস আর হিলারি।
ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর আর রবিন। তারপর উঠে এগিয়ে চলল শৈলশিরা ধরে। যতই এগোচ্ছে, চওড়া হচ্ছে শিরাটা। ওপর থেকে এখন উপত্যকাটা দেখতে পাচ্ছে ওরা। গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে, ঘন সবুজ।
সূর্য ডুবছে। লম্বা লম্বা ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে উপত্যকার ওপর। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নদীটা, বেশ চওড়া হয়ে। দুধারে গজিয়ে উঠেছে লম্বা ঘাস, ঘন ঝোপঝাড়। এখানে ওখানে বাষ্প উড়ছে, নিশ্চয় গরম পানির অনেক ঝর্না রয়েছে ওখানে। উপত্যকার আরেকটা প্রান্ত এত দূরে, চোখেই পড়ে না।
রবিনের দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, তোমার চোখ তো লাল। আমার কি অবস্থা?
কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন। একেবারে গায়ের লোকের মত। কি যেন মনে পড়তে বলল, এই শোনা শোনো, জনের চোখ কিন্তু লাল ছিল না। যেদিন আমরা তাকে দেখেছি সেদিন গাঁয়ের বাইরে থেকে এসেছিল। মনে হচ্ছে গন্ধই ওদের ক্ষতিটা করে। ওরা রয়েছে ভাটিতে, নদীর কিনারে। বাতাস গন্ধকের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে যায় সোজা ওদের দিকে।
তা নেয়, কিশোর বলল। তবে যে হারে অসুস্থ, মনে হয় শুধু গন্ধকের গন্ধে নয়। আরও কোন কারণ আছে। তার হাত-পায়ের কাপুনি এখনও রয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামার কথা ভাবতেই মুখ কালো হয়ে গেল। ইস, রাতটা এখানেই থেকে যেতে পারলে ভাল হত! কিন্তু উপায় নেই। আবার নামতে আরম্ভ করল। রবিনের পিছু পিছু। ওঠাটা যত কঠিন, নামা ততটা নয়, তাই কোন রকম বিপদ না ঘটিয়ে নিরাপদেই পা রাখতে পারল নিজের ঘাসে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। স্বস্তির।
নেমেই চারপাশে চোখ বোলাল সে। কাছাকাছি যে কটা ফার্ন জাতীয় গাছ দেখল, সবগুলোর পাতা, ডাল, ফুল বাদামি হয়ে গেছে। নদীর পানির রঙ ধূসর, তীরের কাছে পানিতে পাতলা সরের মত জমে রয়েছে।
দেখো, রবিনকে বলল সে।
দেখল রবিন। কি মনে হচ্ছে?
অস্বাভাবিক লাগে, তাই না?
পানির দুষণ?
হতে পারে। আমার চোখ জ্বালা করছে। চলো এখান থেকে চলে যাই।
উঁচু পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিয়েছে সূর্য। সোনালি রশ্মি আর ঢুকতে পারছে না, এখানে। ঠাণ্ডা, কালো কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে নদীর ধার ধরে এগোল দুজনে। পানির ধারে ঘন হয়ে জন্মে থাকা ঘাস, লতাপাতা, ঝোপ সব বাদামী হয়ে গেছে, পানির একেবারে লাগোয়াগুলো মরেই গেছে প্রায়।