মরিয়া হয়ে আঙুলগুলোকে আটকে রাখতে চাইল সে। বুকের খাঁচায় পাগল হয়ে গেছে যেন হৃৎপিণ্ডটা, ধড়াস ধড়াস করে লাফ মারছে, বেরিয়ে আসার ষড়যন্ত্র! অনেক চেষ্টা করছে কিশোর, কিছুতেই আটকে থাকছে না আঙুলগুলো। হাতের দিকে তাকাল একবার। ছুটে গেল আঙুল।
সময় যেন স্থির হয়ে গেছে।
জায়গামত রয়েছে কেবল এখন ওর বাঁ হাত আর বাঁ পা।
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে শরীর। ভয়ে দেয়ালের উঁচুতে একপাশের কজা খুলে যাওয়া দরজার পাল্লার মত ঝুলছে সে। এইবার আর আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারল না, ভাবল। নিচের পাথরে পড়ে ছেচে ভর্তা হয়ে যাব!
কিশোর! ওর অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।
সাদা হয়ে গেছে কিশোরের মুখ।
জলদি মুখ চেপে ধর দেয়ালে! চিৎকার করে বলল রবিন। নিচের দিকে তাকাবে না! ভয় যেন অক্টোপাসের বাহু দিয়ে জড়িয়ে চাপ দিচ্ছে ওর বুকে। কিশোরকে বাঁচাতেই হবে। ডান কাঁধটা নাড়াও! ডান পা সরিয়ে নিয়ে যাও দেয়ালের দিকে। খুব আস্তে।
কিন্তু নড়লও না কিশোর।
কি ব্যাপার? শুনতে পায়নি নাকি? আরও জোরে চিৎকার করে ডাকল রবিন, কিশোর! সাড়া পেল না এবারেও। সাহায্য করতে হলে ওর কাছে যেতে হবে। নামতে শুরু করল সে।
রবিন যে আসছে বুঝতে পারল কিশোর। তবে দেখতে পাচ্ছে না। মৃদু খসখস কানে আসছে। নিজে তো বিপদে পড়েছেই, আরেকজনকেও বিপদে ফেলতে যাচ্ছে মনে হতেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন। ধমক দিল নিজেকে, এই গর্দভ! ভয় দূর কর। এভাবে মরার কোন অর্থ হয় না!
পৌঁছে গেল রবিন। কিশোরের ফ্যাকাসে মুখে বেপরোয়া ভাব দেখতে পেল সে। তাকিয়ে রইল রবিন। বুঝতে পারল, আবার চালু হয়ে গেছে কিশোরের খুলির ভেতরে সাংঘাতিক সজাগ ক্ষুরধার মগজটা। এইবার ঠিকমত শ্বাস নিতে পারল রবিন। আশা হল, বেঁচে যাবে এযাত্রা ওর বন্ধু।
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের মুখ। কেঁপে উঠল ডান, কাঁধটা, আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করল দেয়ালের দিকে। তারপর এগোতে শুরু করল ডান পা।
ডান হাতটা নড়ে উঠল। পাথরের গা হাতড়ে হাতড়ে আঁকড়ে ধরার জায়গা। খুঁজছে। পেলও। পা-টা ঢুকিয়ে দিল আরেকটা খাজে। দেয়ালে বুক ঠেকিয়ে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করল, যদিও এই অবস্থায় বিশ্রাম হয় না।
হয়ে গেছে, কিশোর, পেরেছ! আনন্দে চোখ দিয়ে পানি এসে যাওয়ার জোগাড় হলো রবিনের। আর ভয় নেই। এসো, ওঠো আমার পিছে পিছে। ওপরে চ্যাপ্টা একটা জায়গা আছে, ঝোপ আছে, লুকিয়ে থাকতে পারব। আমাদেরকে দেখতে পাবে না ওরা। এসো, কিশোর, আর বেশি ওপরে নেই।
শক্ত হয়ে গেছে যেন বাঁ হাত। নড়াতে পারবে না আর কোনদিনই, পাথরের সঙ্গে থেকে থেকে পাথরই হয়ে গেছে। দুত্তোর বলে জোর করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে এল কিশোর। ওপরে বাড়াল। ধরল আরেকটা খাঁজ। আত্মবিশ্বাস বাড়ল। আবার উঠতে লাগল।
ওপরে ওপরে উঠছে রবিন। অবশেষে উঠে গেল সরু একটা শৈলশিরায়। শিরার কিনারে গজিয়ে আছে কাঁটাঝোপ। মাথা কাত হয়ে আছে নিচের দিকে। ওই ঝোপের ওপাশে কোনমতে চলে যেতে পারলেই হল, লুকিয়ে বসতে পারবে, নিচে থেকে দেখা যাবে না ওদেরকে।
এসে গেছে ওরা! বলল রবিন, আরেকটু তাড়াতাড়ি করো!
পারল না কিশোর। সেই একই রকম শামুকের গতি। হাত-পা যে আর ফসকাচ্ছে না, এতেই খুশি সে। তাড়াহুড়া করার ক্ষমতাই নেই। দীর্ঘ অনেকগুলো যুগ পার হয়ে যেন অবশেষে রবিনের কাছে উঠে আসতে পারল সে। ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে নিচের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল রবিন। কিশোরের একটা হাত চেপে ধরে তাকে শৈলশিরায় উঠতে সাহায্য করল।
যাক, পারলে শেষ পর্যন্ত! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন।
কিছু বলল না কিশোর। গড়িয়ে গড়িয়ে কোনমতে ঢুকল ঝোপের ভেতর। চুপ করে বসে চোখ মুদল।
কতটা কাছে এল? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।
অনেক কাছে, রবিন জানাল। দেখো না।
প্রপাত থেকে ওঠা শীতল বাষ্প উড়ছে বাতাসে। উপত্যকার দিক থেকে আসা বাতাসের ঝাঁপটায় উড়ে চলে যাচ্ছে, সেই জায়গায় ঠাই নিচ্ছে নতুন বাষ্প। চোখ মেললেই জ্বালা করে। তবু জোর করে তাকিয়ে রয়েছে জোনস আর তার সঙ্গীদের। দিকে। প্রপাতের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে ওরা।
শয়তানগুলো গেল কোথায়? ফোঁস করে উঠল জোনস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকাতে লাগল পাহাড় আর বনের দিকে।
প্রপাতের গর্জনকে ছাপিয়েও তার কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে বলল, তোমাদের দোষ! গাধা কোথাকার! আটকাতে পারলে না!
এখানেই কোথাও আছে ওরা, বসো! হিলারি বলল।
বের করে ফেলব! বলল ডক।
তাহলে করছ না কেন? খেঁকিয়ে উঠল জোনস। কিছুতেই পালাতে দেয়া চলবে না। ওই খুঁতখুঁতে সাংবাদিকটাকে আটকেই ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে। যাবে। ছেলেগুলো যে এতটা বিচ্ছু কল্পনাই করতে পারিনি!
সাংবাদিক কথাটা শুনে পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
মনে হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল কিশোর, কোন কিছুর তদন্ত করে রিপোর্ট লিখতে এসেছিলেন আংকেল, সে জন্যেই তাকে আটকানো হয়েছে। ডায়মণ্ড লেকের গল্পের সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক আছে।
ভাবছি, হেরিং লোকটা কে? কি জানে?
এমন ভাবে সারতে হবে, জোনস বলছে, যাতে মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।
তা করা যাবে। হেরিংকে যা করেছি তা-ই করব। পাথরে মাথা ঠুকে আগে বেহুশ করে নেব। তারপর ফেলে দিলেই হবে, ডক বলল।