মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে উঠল রবিন।
সময় মতই এসেছি, কিশোর বলল। লাঞ্চ ওখানে গিয়েই করতে পারব।
এইবার একটা কথার মত কথা বলেছ, মাথা দোলাল মুসা।
এই সময় ছোট্ট একটা ঝাঁকি দিল সেসনা। কিশোরের সে রকমই মনে হলো। প্রায় টেরই পাওয়া যায়নি…
তোমরা কি… কথা শেষ করতে পারল না সে।
একে অন্যের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। পরক্ষণেই একযোগে তাকাল। সামনের দিকে, যেখানে সেসনার একমাত্র ইঞ্জিনটা রয়েছে।
বদলে গেছে ইঞ্জিনের গুঞ্জন।
আঙ্কেল… চিৎকার করে উঠল কিশোর। এবারেও কথা শেষ করতে পারল না সে।
থেমে গেছে ইঞ্জিন।
কন্ট্রোলের ওপর পাগলের মত ছোটাছুটি করছে মিলফোর্ডের আঙুল। দুই বছর হল পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছেন তিনি, বহুবার আকাশে উঠেছেন বিমান নিয়ে, কখনও কোন গোলমালে পড়েননি।
অসংখ্য সুইচ টেপাটিপি করলেন তিনি, গজগুলো চেক করলেন, তারপর যখন দেখলেন কোনটাই কাজ করছে না, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওগুলোর দিকে। কাটাগুলো সব নিথর হয়ে আছে, নড়ে না, ডিজিটাল নম্বরগুলো যেখানে ছিল সেখানেই আটকে গেছে। অলটিচিউড, এয়ার স্পীড, ফুয়েল…
ইলেকট্রিক্যাল সিসটেমটা গেছে! বিড়বিড় করল রবিন।
ইঞ্জিন? জবাব জানা হয়ে গেছে কিশোরের, তবু প্রশ্নটা করল।
ডেড! মিলফোর্ড বললেন।
.
০২.
কাগজের খেলনা বিমানের মত ভেসে চলেছে সেসনা। ইঞ্জিন স্তব্ধ। চারপাশে শিস দিচ্ছে যেন বাতাস, গোঙাচ্ছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে থাবা দিয়ে। মাইক্রোফোনটা তুলে নিয়ে সুইচ টিপলেন মিলফোর্ড।
মে-ডে! মে-ডে! তার কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু জরুরী। সেসনা নভেম্বর থ্রি সিক্স থ্রি এইট পাপা থেকে বলছি। আমাদের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। নিচে পড়ছি। পজিশন জিরো ফোর সেভেন রেডিয়াল অভ ব্যাকারসফিল্ড ভি ও আর অ্যাট সেভেন্টি ফাইভ ডি এম ই।
মাইক্রোফোনটা রবিনের হাতে গুঁজে দিয়ে আবার স্টিক ধরলেন তিনি।
একই কথা বলতে লাগল রবিন, সেসনা নভেম্বর…
হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিলফোর্ডের চেহারা। রবিন, লাভ নেই! রেখে দাও!
মানে?
অহেতুক কথা বলবে, বুঝে ফেলেছে কিশোর, লাভ হবে না। মেসেজ যাবে না কোথাও। বিদ্যুতই নেই। রেডিও অচল।
আরি, ভুলেই গিয়েছিলাম, রবিন বলল, ইমারজেন্সি লোকেটর বিকন আছে একটা। প্লেন ক্র্যাশ করলে আপনা-আপনি চালু হয়ে যায় ওটা।
অনেক ধন্যবাদ, আমি ক্র্যাশ করতে চাই না, দুই হাত নাড়ল কিশোর। দ্রুত হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি। নিরাপদে এখন কোনমতে মাটিতে নামতে পারলে…
হ্যাঁ, আমারও এই কথা, মুসা বলল।
নীরবে সিটবেল্ট বাঁধতে লাগল ওরা।
গ্র্যানিটের একটা চূড়ার দিকে নাক নিচু করে ধেয়ে চলেছে বিমান। বাড়ি লাগলে ডিমের খোসার মত গুঁড়িয়ে যাবে।
মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের পেট। ভয় পেলে যা হয়। ঘামতে আরম্ভ করেছে।
মুঠো খুলে-বন্ধ করে আঙুলের ব্যায়াম করতে লাগল মুসা, আনমনে, যেন পতনের পর পরই কোন কিছু আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্যে তৈরি হচ্ছে। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে পেশী।
ঢোক গিলল রবিন। সহজ ভাবে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে। যাচ্ছি কোথায় আমরা? স্বর শুনে মনে হলো গলায় ফাঁসি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
ওই তৃণভূমিটায় নামার চেষ্টা করব, মিলফোর্ড বললেন।
তৃণভূমিটা বেশ বড়, উপত্যকার পুব ধারে।
কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আর মিনিট তিনেক।
পাথর হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। বাতাস চিরে নিচে নামছে বিমান। দ্রুত বড় হচ্ছে গাছপালা, গ্র্যানিটের চাঙড়। তৃণভূমির উত্তরের পাহাড়টা লম্বা হচ্ছে, সাদা হচ্ছে, মাথা তুলছে যেন দানবীয় টাওয়ারের মত।
মায়ের কথা ভাবল রবিন। কাগজে যখন পড়বেন, সে আর তার বাবা মারা। গেছেন বিমান দুর্ঘটনায়, দুঃখটা কেমন পাবেন? নিশ্চয় ভয়াবহ।
মাটির যত কাছাকাছি হচ্ছে ততই যেন গতি বেড়ে যাচ্ছে বিমানের।
মাথা নামাও! চিৎকার করে বললেন মিলফোর্ড। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরো। শক্ত করে!
বাবা…
জলদি করো! কথা বলার সময় নেই!
মাথা নুইয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরল, কিংবা বলা যায় বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল তিনজনে।
যাই হোক, চাকাগুলো ঠিকই আছে, বিড়বিড় করে নিজেকেই সান্ত্বনা দিল রবিন। ধাক্কা কিছুটা অন্তত বাঁচাবে।
ব্রেকের কথা উল্লেখ করল না কেউ। লাভ নেই। ইলেকট্রিক সিসটেম বাতিল, কাজেই ব্রেক কাজ করবে না।
বিমানের চারপাশে বাতাসের গর্জন বাড়ছে।
হয়েছে! এইবার! ভাবতে গিয়ে গায়ে কাটা দিল রবিনের।
মাটিতে আছড়ে পড়ল বিমান।
প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে ছিটকে যেতে চাইল ওদের শরীর, সীট বেল্টে টান। লেগে আবার ফিরে এসে পিঠ বাড়ি লাগল সিটের হেলানে। রবিনের মনে হলো, তীক্ষ্ণ ব্যথা যেন লাল সাদা স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে গেল চোখে।
পড়েই বলের মত ড্রপ খেয়ে লাফিয়ে উঠল বিমান, ভয়ঙ্কর গতিতে আবার আছাড় খেল। সীট বেল্টে আটকানো মানুষগুলোকে এলোপাতাড়ি ঝাঁকিয়ে দিল। আবার লাফিয়ে উঠল।
শক্ত হয়ে থাক! চিৎকার করে হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড।
তৃতীয় বার মাটিতে পড়ল বিমান। কাপল, ঝাঁকি খেল, দোল খেল, গোঙাল। তবে আর লাফ দিল না। সামনের দিকে দৌড়াল মাতালের মত টলতে টলতে।
সীট আঁকড়ে ধরেছে রবিন। মাথা নিচু করে রেখেছে। ভীষণ ঝাঁকুনি লাগছে। মনে হচ্ছে, শরীরের ভেতরের যন্ত্রপাতি সব ভর্তা হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে আছে এখনও, তবে আর কতক্ষণ?