মাথা তুলল মুসা। তৃণভূমিতে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জোনসকে দেখতে পাচ্ছে। লোকটার হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা ওয়াকি-টকি। সেটাতেই কথা বলে আদেশ দিচ্ছে।
ডক সেই দুজনের একজন, রবিন বলল ফিসফিসিয়ে, যারা বনের ভেতর তাড়া করেছিল আমাদের। গলা খুবই কর্কশ।
তাহলে হিলারি নিশ্চয় অন্য লোকটা, কিশার অনুমান করল। ওরা আমাদের খেদিয়ে নিয়ে গিয়ে জোনসের মুখে ফেলেছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল আমার, এত সহজে পিছ ছেড়ে দিল দেখেই। জোনসের সিগারেট আর প্যাকিং বাক্সের গায়ে লেখা নাম বিশ্লেষণ করে কি বের করেছে, দুই সহকারীকে জানাল সে।
অসম্ভব, মানতে পারল না রবিন। পিকআপটাকে স্যাবোটাজ সে করেনি। ছিলই না গাঁয়ে, কি করে করবে?
আমার বিশ্বাস, মুসা বলল, শয়তানীটা মোড়লের।
আপাতত ওসব চিন্তা বাদ, কিশোর বলল, পরে ভাবা যাবে। চলো, চলো।
বাবার কি হবে? রবিন জিজ্ঞেস করল।
একটা ব্যাপারে আমরা এখন শিওর, কিশোর বলল, জোনসের কথা থেকে। আঙ্কেল জীবিতই আছেন। আগে আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হবে। তারপর খুঁজে বের করব তাকে।
তুণভূমির দিকে তাকাল তিনজনেই। বনের দিকে তাকিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জোনস।
গুলি বাঁচাচ্ছে ব্যাটা, কিশোর বলল। আমাদের না দেখে শিওর না হয়ে গুলি করবে না।
আস্তে করে উঠে দাঁড়াল তিনজনে। মাথা নিচু করে পা টিপে টিপে এগোল বনের দিকে।
ওই যে! ওই তো! ডকের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল।
ছয় কদম দৌড়ে গিয়ে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গোয়েন্দারা।
তাকিয়ে রয়েছে আরেকটা এম-১৬ রাইফেলের দিকে।
এবার রাইফেল তাক করেছে কালো চুল, রোদে পোড়া চামড়া, নীল চোখওয়ালা একটা লোক। নলের মুখ ঘোরাচ্ছে একজনের ওপর থেকে আরেকজনের ওপর। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ঠোঁটে, ঠোঁটেই রইল, মুখে ছড়াল না হাসিটা।
ধরেছি, বলল লোকটা। ওর কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারল গোয়েন্দারা, হিলারি।
বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। তার হাতেও একটা এম-১৬।
পালিয়ে বাঁচতে আর পারলে না, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল ডক। ছোটখাট শরীর, খাটো করে ছাঁটা বাদামী চুল, ঘন ভুরু। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন নেই ছেলেগুলোর। বেপরোয়া, এই যা।
পেছন থেকে শোনা গেল জোনসের কথা, যাও, নিয়ে চল ওদের। অনেক পথ যেতে হবে।
কি বলল শুনলে তো? গোয়েন্দাদেরকে বলল ডক। হট।
শ্রাগ করল মুসা। চুপ করে রইল রবিন আর কিশোর। আদেশ পালন না করে আর উপায় নেই।
কি হলো! ধমকে উঠল ডক, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
বলেই ভুলটা করল। মুসার পিঠে চেপে ধরল রাইফেলের নল।
গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। একপাশ থেকে থাবা দিয়ে ধরে ফেলল নল। ওভাবে ধরেই জোরে এক ঠেলা দিয়ে বাঁটের গুতো মারল ডকের। পেটে। হুক করে উঠল লোকটা। হা হয়ে গেছে মুখ। হাসফাস করছে বাতাসের জন্যে।
দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পড়তে আরম্ভ করল।
রবিনও চুপ করে রইল না। ঝট করে পা সোজা করে অনেক উঁচুতে তুলে হফেলল। লাথি চালাল, কারাতের ইওকো-গেরিকিয়াজ হিলারির চোয়ালে লাগল লাথিটা। টলে উঠে পিছিয়ে গেল হিলারি। এক লাফে আগে বেড়েই আবার একই কায়দায় লাথি মারল রবিন। কাটা কলাগাছের মত ঢলে পড়ে গেল হিলারি।
এক দৌড়ে পাইনের জটলায় ঢুকে পড়ল কিশোর। বনের প্রান্তে থাকা জোনসের ওপর তার জুডোর প্র্যাকটিসটা করার ইচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বাতিল করে দিল সে। জুডো কারাত কোনটারই দরকার পড়ল না। গাছের আড়াল থেকে শুধু একটা পা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল সামনে। কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি জোনস, সতর্ক ছিল না, কিশোরের পায়ে হোঁচট খেল।
ততক্ষণে মুসাও পৌঁছে গেছে সেখানে। কনুই দিয়ে অতোশি হিজি-আতি মারল জোনসের ঘাড়ে। হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে বিশালদেহী। লোকটা।
মুহূর্ত দেরি করল না তিন গোয়েন্দা। এক ছুটে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে।
পেছনে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল জোনস, ধর, ধর ওদেরকে! পালিয়ে গেল তো!
থামল না ছেলেরা। গাছের পাশ কাটিয়ে, পাথর ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণে। পেছনে শোনা যাচ্ছে ভারি জুতো পায়ে ছুটে আসার শব্দ।
ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা। হতাশা বাড়ছে, যখন দেখছে জুতোর শব্দ থামছে না, কাছেই আসছে আরও।
পশ্চিমে ঘুরে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটল মুসা। রাস্তাটা চিনতে পারল রবিন। ঝর্না থেকে পানি ভরতে এসেছিল সেদিন এই পথেই।
একটা বুদ্ধি বের করতে হবে,হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। এভাবে চলে পারব না!
বাবাকেও বাঁচাতে হবে! বলল রবিন।
পেছনে উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল।
রাস্তাটা পেয়ে গেছে ব্যাটারা, মুসা বলল।
রাস্তা ধরে ছুটলে ঠিক এসে আমাদেরকে ধরে ফেলবে, বলল রবিন।
পিকাপের কথা ভুলে যেতে হবে আমাদের, ছুটতে ছুটতেই বলল কিশোর। মুসা, জোনস যে রাস্তাটার কথা বলেছে সেটা খুঁজে বের করতে পারবে?
কাঠ নেয়ার রাস্তা, বিড়বিড় করল মুসা, হাইওয়েতে গিয়ে যেটা পড়েছে। মালটি বলেছিল অবশ্য ওটার কথা। ইনডিয়ানদের রাস্তাটা বোধহয় ওটাতেই পড়েছে।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর। বনের ভেতর কিভাবে বাঁচতে হয়, জানা আছে তোমার। ইস, কেন যে তোমার মত ট্রেনিংটা নিলাম না, কাজে লাগত! বাঁচলে ফিরে গিয়ে নিশ্চয় নেব এবার…
কি করতে হবে সেকথা বলো? বাধা দিয়ে বলল মুসা।