শেষে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোর বলল, মুসা, গাড়িটা তো গেল!
দামটা দিয়ে দিতে হবে! বলল রবিন।
ভাল ড্রাইভার বলে তোমার সুনাম আর থাকবে না!
কোন কথারই জবাব দিল না মুসা। কেবল ঘুরে তাকাল দুই বন্ধুর দিকে।
তবে যত যা-ই হোক, হেসে মুসার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল কিশোর, তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা আমাদের নেই।
দেখালে বটে! রবিনও হাসল। চাপড় দিল মুসার বাহুতে।
হাসতে আরম্ভ করল মুসা। বাচলাম তো, কিন্তু বাঁচার আনন্দে সারাদিন বসে থাকলে চলবে না। কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখা দরকার।
নেমে পড়ল ওরা।
বডির বাঁ পাশে রঙ বলতে আর কিছু নেই, ঘষা খেয়ে উঠে গেছে। মরচেও নেই। চকচক করছে ইস্পাত। লম্বা কাটা রয়েছে অনেকগুলো। ধারাল পাথরে লেগে ওই অবস্থা হয়েছে। দরজার হাতলটা গায়েব। সামনের ফেণ্ডারের একটা মাথা বেঁকে গেছে।
চমৎকার! ফিরে এসে আবার গাড়িতে উঠল মুসা।
তার পেছনে এল কিশোর।
মেঝেতে প্রায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। মাথা চলে গেছে স্টিয়ারিং হুইলের নিচে। ফুট পেড়ালের রডটা পরীক্ষা করল। একটা বোল্ট তুলে নিল মেঝে থেকে।
কি ব্যাপার? অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
স্টিয়ারিঙের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে মাথা তুলল মুসা। নীরবে বোল্টটা তুলে দিল কিশোরের হাতে।
কিশোরও ভাল করে দেখল জিনিসটা। লোহাকাটা করাতের দাগ দেখতে পেল ওতে। অনেকটাই কেটেছে। দেখে তুলে দিল রবিনের হাতে। ব্রেক কেন কাজ করছিল না, বোঝা গেল এতক্ষণে।
ঠিক, আঙুল তুলল মুসা। ব্রেক পেডাল একটা শ্যাফটের সঙ্গে লাগানো থাকে, যেটার সঙ্গে মাস্টার সিলিণ্ডারের যোগাযোগ। পেডালে চাপ দিলেই সিলিণ্ডারের পিস্টন ব্রেক লাইনের ব্রেক ফ্লুইডের ওপর চাপ বাড়ায়…
আসল কথা বলো, বাধা দিয়ে বলল রবিন, কি বলতে চাও?
বলছি, বলছি। শ্যাফটের সাথে পেডালটাকে আটকে রাখতে এই বোল্টটা দরকার।
এবং কেউ এটাকে এমন ভাবে কেটে রেখেছে, যোগ করল কিশোর, যাতে বেশি জোরে চাপ পড়লেই ভেঙে যায়।
তা-ই করেছে, মাথা দোলাল মুসা।
গুঙিয়ে উঠল রবিন। ওর বাবাকে খুঁজতে যাওয়ার পথে আবার বিরাট বাধা এসে হাজির।
একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে।
কে করল কাজটা? রবিনের প্রশ্ন।
ইনডিয়ানদেরই কেউ হবে, জবাব দিল কিশোর।
মোড়ল? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা। আমাদের পছন্দ করেনি, এটা বোঝা গেছে তখনই। কিন্তু এতটাই অপছন্দ যে খুন করার চেষ্টা করল?
জন করেনি তো? ভুরু কোঁচকাল রবিন।
কিংবা মালটি? বলল কিশোর।
নাহ, ও করবে বলে মনে হয় না, মুসা বলল।
যে-ই করে থাকুক, রবিন বলল, সাহায্যের জন্যে আর ওখানে যাওয়া যাবে না।
প্রশ্নই ওঠে না, বলল কিশোর। খুন করতে চেয়েছিল আমাদের, আবার যাব? যেতে হবে ডায়মণ্ড লেকে, যে করেই হোক। ব্রেকটা ঠিক করতে পারবে?
নতুন একটা বোল্ট পেতে পারি। কিন্তু পাব কোথায়?
ট্রাকের ভেতরে খুঁজে এল সে আর রবিন। কিছুই পেল না। একটা জ্যাকও না, সাধারণত যে টুলসটা সব গাড়িতেই রাখা হয়।
সেসনাতে পাওয়া যাবে না তো? মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, পেছনের জিনিসপত্রের মাঝে টুলস দেখেছি বলে মনে পড়ে। বলেই আর দাঁড়াল না। পাহাড়ের দিকে রওনা হয়ে গেল।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা আর রবিন।
আরি, ওই পাহাড়টাই তো! অবাক হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।
মনে তো হচ্ছে, ওর দিকে না তাকিয়েই বলল কিশোর। ওটা ধরে তৃণভূমিতে যেতে পারব আমরা, বোল্ট নিয়ে ফিরে এসে ব্রেক মেরামত করে চলে যৗব ডায়মণ্ড লেকে, সাহায্য নিয়ে খুঁজতে বেরোব আঙ্কেলকে। খুব সহজ ভাবেই কথাগুলো বলল বটে কিশোর, কিন্তু আবার পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই সিটিয়ে গেল মন। আরেকবার ওই ভয়ানক পরিশ্রম করতে মন চাইছে না।
ট্রাকের পেছন থেকে পানির বোতলটা নামিয়ে আনল রবিন। যার যার জ্যাকেট কোমরে জড়িয়ে নিল, ঠাণ্ডা পরলে গায়ে দেবে। এগিয়ে গেছে কিশোর। তার পেছনে চলল দুজনে। যে পথে এসেছে ওই পথ ধরেই পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। পিকআপের ঘষায় গ্র্যানিটের দেয়ালের গভীর আঁচড়গুলো দেখতে পেল ওরা। এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখল দরজার হাতলটা। এক লাথিতে রাস্তার পাশের এক ঝোপে পাঠিয়ে দিল ওটাকে রবিন।
কিছুদূর এগোনোর পর যেখানে রাস্তাটা দক্ষিণে ইনডিয়ানদের গায়ের দিকে চলে গেছে, সেখানে এসে পশ্চিমে মোড় নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।
খানিক পরেই ঘন হয়ে এল পাইন, উঁচু মাথাগুলোর ওপরটা বাঁকা হয়ে আছে। ধনুকের মত। পাখি ডাকছে প্রচুর। হালকা বাতাস দোলা দিয়ে গেল ডালে ডালে। বাইরে বিকেলের রোদ, অথচ বনের ভেতরে এখানে বেশ ছায়া, ঠাণ্ডাও।
হঠাৎ গুলির শব্দ হলো।
মুসার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল বুলেট। থ্যাক করে বিধল একটা গাছে। কলরব করে উড়ে গেল একঝাঁক পাখি।
গুলির পর পরই ঝাঁপ দিয়েছে তিনজনে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে মাটিতে।
আবার গুলি হলো। মাথার ওপর দিয়ে বাতাস কাটার শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল বুলেট। শুয়ে শুয়েই তাকাল ওরা পরস্পরের দিকে।
কেউ গুলি করছে ওদের লক্ষ করে!
১০.
গেল কোথায়? পেছনের বন থেকে বলল একটা কর্কশ কণ্ঠ।
দাঁড়িয়ে পড়লে কেন আবার? এস…অ্যাই ডক, বলল আরেকটা কণ্ঠ, খুঁজে বের করতে হবে ওদের। ঘন গাছপালার ভেতরে কথা বললে শব্দটা ঠিক কোনখান থেকে আছে বোঝা মুশকিল।