আবার পাহাড়ের দেয়ালের দিকে গাড়ির নাক ঘোরানোর চেষ্টা করল মুসা। দেরি করে ফেলল। আলগা পাথরে পিছলে গিয়ে আবার খাজের মধ্যে পড়ল চাকা।
মরলাম আবার! মুসা বলল।
খাঁজ ধরে ছুটতে ছুটতে পরের বাকটার কাছে চলে এল গাড়ি, উড়ে পেরিয়ে এল যেন।
আরি! বলে উঠল রবিন, ওড়াল দেবে নাকি!
সামনে একটা ছোট পাহাড় দেখা গেল। ঢালটা খুব ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে, খাড়াই কম।
এইবার আরও মরলাম! ঘামে চকচক করছে কিশোরের মুখ।
গর্জন করতে করতে তীব্র গতিতে পাহাড়ের গোড়ার দিকে ধেয়ে গেল গাড়ি। উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। যেন সাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ে পড়েছে, দোল খেতে লাগল। ভয়াবহ গতিবেগ অব্যাহত রেখেছে।
স্টিয়ারিং ছাড়ছে না মুসা। চেপে ধরে রেখেছে প্রাণপণে। খোলা জানালার কিনার খামচে ধরেছে রবিন, যেন সারা জীবনের জন্যে ধরেছে, ছাড়ার ইচ্ছে নেই। দুজনের মাঝে বসে দরদর করে ঘামছে কিশোর। এক হাতে ড্যাশবোর্ডে, আরেক হাত ছাতে ঠেকিয়ে চাপ দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করছে নিজেকে।
অনেক পেছনে সরে গেছে আগের পাহাড়টা। সামনে পথের দুধারে ঘন হয়ে জন্মেছে ঝোপঝাড়। ওপরে উঠতে গিয়ে ধীরে ধীরে গতি কমে আসছে পিকআপের।
কিছুটা স্বস্তি বোধ করল তিন গোয়েন্দা। চূড়াটা.মালভূমির মত সমতল হয়ে। থাকলে হয়তো থেমে যাবে গাড়ি…
সর্বনাশ! গাড়ি চূড়ায় পৌঁছতেই চিৎকার করে উঠল কিশোর।
গতি অনেকটা কমেছে, কিন্তু তারপরেও যা রয়েছে, অনেক। চূড়াটা সমতল নয়। লাফ দিয়ে চূড়া পেরোল গাড়ি, আঁকুনিতে হাড়গোড় সব আলাদা হয়ে যাবে বলে মনে হলো অভিযাত্রীদের, ওপাশের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। গতি বেড়ে গেছে আবার। সাট সাট করে পাশ দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে যেন গাছপালা।
গাড়িটাকে বাগে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা। এরই মাঝে চিৎকার করে সঙ্গীদেরকে হুঁশিয়ার করল, শক্ত হয়ে বসে থাকার জন্যে।
কিন্তু থাকাটা মোটেও সহজ নয়। সীটবেল্ট নেই। ঝটকা দিয়ে দিয়ে এদিকে কাত হয়ে পড়ছে, ওদিকে কাত হয়ে পড়ছে, লাফ দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। গাড়িটার যেন ম্যালেরিয়া হয়েছে, এমনই কাঁপুনি। সেই সঙ্গে নাচানাচি তো আছেই। আবার খাজের মধ্যে পড়ে গেছে চাকা।
নাহ, আর বাঁচোয়া নেই! কিশোর বলল, খুলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। বডি!
তাই তো মনে হচ্ছে! জানালার ধার থেকে হাত সরায়নি রবিন।
হঠাৎ রাস্তার ডানপাশটা অদৃশ্য হয়ে গেল। গাছের মাথা চোখে পড়ছে, বেরিয়ে আছে নিচে থেকে, পথের ওপরে এসে পড়েছে ডাল পাতা। খানিক পরে আর তা-ও থাকল না। একশো ফুট নিচে খাড়া নেমে গেছে ওখানে পাহাড়ের দেয়াল, ঢাল নেই যে গাছ জন্মাবে। নিচে জন্মে রয়েছে পাইন, কাঁটাঝোপ। মাঝে মাঝে বেরিয়ে আছে পাথরের চাঙড়। ওগুলোর কোনটায় গিয়ে যদি আছড়ে পড়ে গাড়ি, ছাতু হয়ে যাবে।
যে খাজকে এতক্ষণ গালাগাল করছিল মুসা, সেটাকেই এখন আশীর্বাদ বলে। মনে হচ্ছে। বের করার তো এখন প্রশ্নই ওঠে না, ভেতরে রাখার জন্যেই যেন যত চিন্তা।
এই দেখো দেখো! উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করল মুসা।
সামনেই দেখা গেল ওটা, ওদের এই দুঃস্বপ্ন-যাত্রার অবসান ঘটাতেই যেন। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিটের উঁচু দেয়াল। পুব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। ডানে মোড় নিয়ে ওটার পাশ দিয়ে চলে গেছে পথ। যে গতিতে চলছে, যদি নাক ঘোরাতে না পারে, যদি সোজাসুজি গিয়ে…আর ভাবতে চাইল না মুসা। বলল, গাড়ির পাশটায় ঘষা লাগালে কেমন হয়? থেমেও যেতে পারে।
পাগলামি! স্রেফ পাগলামি! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। গাড়ির পাশ ছিঁড়ে খুলে রয়ে যাবে!
আর ঘষা লাগলেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটবে, বলল রবিন। একটা কণা যদি গিয়ে লাগে ট্যাঙ্কে, ব্যস, ভ্রম!
আর কোন ভাল বুদ্ধি দিতে পার? রেগে গিয়েই বলল মুসা।
চুপ হয়ে গেল রবিন আর কিশোর। গাড়িটাকে রোখার আর কোন উপায়ই বলতে পারল না। পথের বাঁয়ে যেন আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিটের দেয়াল, চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে।
খেপা জানোয়ারের মত গর্জন করতে করতে ছুটছে ফোর্ড। জোরাজুরি করে আরও একবার খাজ থেকে চাকা তুলে আনল মুসা।
ঘাঅ্যাস করে দেয়ালে ঘষা লাগল পিকআপের এক পাশ। ঝনঝন করে উঠল। শরীর। আগুনের ফুলকি ছিটাল একরাশ।
চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
আর কোন দিকে নজর নেই মুসার, দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে ধূসর দেয়ালের দিকে। আবার সামান্য বাঁয়ে স্টিয়ারিং কাটল সে। এ্যানিটে ঘষা খেল পিকাপের নাক। আবার ফুলকি ছুটল। আবার লাগাল। আবার ফুলকি।
গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।
যা করছ করে যাও, কিশোরও বুঝতে পারছে এছাড়া আর কোন উপায় নেই।
পারবে! আশা বাড়ছে রবিনের। মনে হচ্ছে পারবে এভাবেই। চালিয়ে যাও।
সাহস পেল মুসা। আবার কাটল স্টিয়ারিং। দেয়ালে তো লাগাল পিকআপ, এ্যানিটে ঘষা লেগে ছেড়ে যাওয়ার সময় তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলল গাড়ির ধাতব শরীর, নাগাড়ে ফুলকি ছিটিয়ে চলেছে।
দরদর করে ঘামছে তিন গোয়েন্দা।
গতি কমে এল পিকআপের। এগোনর চেষ্টা করেও পারছে না। প্রচণ্ড চাপে গুঙিয়ে উঠছে বডি।
অবশেষে থামতে বাধ্য হলো গাড়ি। ইঞ্জিন চলছে। বন্ধ করে দিল মুসা। বা দিকের সামনের ফেণ্ডার ঠেকে রয়েছে দেয়ালে।
সীটে হেলান দিয়ে জোরে জোরে দম নিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেছে সব কিছু। বাতাসে ধুলোর ঘূর্ণি। কেউ নড়ছে না, কোন, কথা বলছে না।