মোড়ল চাচার, মালটি বলল। খুব ভাল মানুষ। রাইফেলে দারুণ নিশানা। নতুন কাপড়, কাজের যন্ত্রপাতি আর গাড়ির পার্টস ভেঙে গেলে এনে দেন। আমাদের।
টাকা পান কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।
ত্যাগ করল মালটি। জানি না। ডায়মণ্ড লেকে পার্ট-টাইম কোন কাজ করেন বোধহয়। ওসব আমার ব্যাপার নয়, মাথাও ঘামাই না। রঙচটা, মরচে পরা একটা পুরানো ফোর্ড ফ-১০০ গাড়ির ফেণ্ডারে চাপড় দিল সে। এটাই তোমাদের দেয়া হয়েছে। যত্ন করবে। কাজ শেষে ডায়মণ্ড লেকে রেঞ্জার স্টেশনে রেখে যেও, তাহলেই হবে।
জিনিসপত্র যা সঙ্গে আনতে পেরেছে সেগুলো গাড়ির পেছনে রেখে সামনের সীটে উঠে বসল তিনজনে। সীটবেল্ট নেই। স্টিয়ারিঙে বসল মুসা। তিনজনের মাঝে সব চেয়ে ভাল ড্রাইভার সে।
উত্তর দিকে যাবে, বলে দিল মালটি। কিছু দূর গেলে একটা দোরাস্তা দেখতে পাবে, কাঠ ব্যবসায়ীরা তৈরি করেছে। পশ্চিমের কাঁচা রাস্তাটা ধরবে, তাহলেই পৌঁছে যাবে হাইওয়েতে। ডানে যাবে, ডায়মণ্ড লেকে চলে যেতে পারবে।
মালটিকে ধন্যবাদ দিল ওরা। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। হেসে, হাত নেড়ে ওদেরকে বিদায় জানাল মেয়েটা। রওনা হয়ে গেল ওরা। ব্যাকফায়ার করছে। পুরানো ইঞ্জিন। তবে চলছে। চাকার পেছনে ধুলো উড়ছে। ঘেউ ঘেউ করছে কুকুর।
যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, একটা গাড়ি পেলাম শেষ পর্যন্ত। পায়ে না হেঁটে চাকার ওপর গড়ানো।
হ্যাঁ, রবিন বলল। ধন্যবাদটা কিশোরেরই পাওনা। ও কথাটা মনে করেছিল। বলেই পেলাম।
সীটে হেলান দিয়ে আছে কিশোর। চুপচাপ।
পথের দিকে নজর দিল মুসা। সরু রাস্তা। উঁচু-নিচু। যেখানে-সেখানে মোড়। একটু অসতর্ক হলেই বিপদে পড়তে হবে। রেডউডের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাইনের বনে ঢুকল গাড়ি। পাহাড়ী উপত্যকায় ঢেউ খেলে যেন এগিয়ে গেছে পথ, একবার উঠছে একবার নামছে, একবার উঠছে একবার নামছে।
মোড়ল আমাদের পছন্দ করেনি, একসময় মুসা বলল।
শামান করেছে, বলল কিশোর। ও রাজি হওয়াতেই গাড়িটা পেলাম আমরা। ওর চেহারা দেখেছ, ভাবসাব, যখন দৈব নির্দেশ পাওয়ার কথা বলল জন? মেসেজের মানে বুঝতে পেরেছে, এবং বুঝে খুশি হতে পারেনি।
মালটির চাচার কি হয়েছে, বলো তো?
এক মাস অনেক সময়। রহস্য বলা চলে। আরেকটা রহস্য হলো ওই মানুষগুলোর আজব অসুখ। ভাইরাসের আক্রমণ হতে পারে, কিন্তু ভাবছি… আচমকা নীরব হয়ে গেল কিশোর। চিমটি কাটতে লাগল নিচের ঠোঁটে। কোন কিছু ভাবিয়ে তুলেছে ওকে।
যেখান থেকে রওনা হয়েছে, তার মাইল দুয়েক আসার পর চড়াই বাড়তে লাগল। অনেক খাড়া হয়ে এখানে উঠে গেছে পথ। সুগন্ধী পাইনের বনে ঝলমল করছে বিকেলের রোদ।
পাহাড়ের ওপরে উঠে জোরে জোরে ব্যাকফায়ার করতে লাগল ইঞ্জিন। থামল না। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল গাড়ি। চড়াইটা যেমন খাড়া ছিল উতরাইটা তেমনি ঢালু। দ্রুত গতি বাড়ছে গাড়ির।
ব্রেক চাপল মুসা। গতি কমল গাড়ির। ব্রেক ছেড়ে দিতেই আবার বাড়তে লাগল, দ্রুত, আরও দ্রুত। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে গাছপালা ঝোপঝাড়।
ব্রেক চাপল আবার মুসা। গতি কমল গাড়ির। হঠাৎ মেঝেতে গিয়ে লেগে গেল ফুট পেডাল। নিচের দিকে ছুটতে লাগল আবার গাড়ি। অকেজো হয়ে গেছে। ব্রেক।
খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা, ব্রেকটা গেল?
.
০৯.
ক্রমেই গতি বাড়ছে পিকআপের। মাটিতে গভীর খাঁজ, অনেকটা রেল লাইনের মত কাজ করছে। তাতে ঢুকে গেছে চাকা। ফলে খাজ যেভাবে এগিয়েছে সেভাবেই চলতে হচ্ছে গাড়িটাকে, আর কোন দিকে ঘোরানোর উপায় নেই।
শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে মুসা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ঝাঁকি খাচ্ছে পাশে বসা কিশোর। তার পাশে বসা রবিন আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্যাসেঞ্জার ডোরের আর্মরেস্ট। মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠছে তিনজনের শরীর, ছাতে মাথা বুকে যাওয়ার অবস্থা।
ইমারজেন্সি ব্রেক! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
সাংঘাতিক জোরে চলছে, জবাব দিল মুসা। কোন কাজই করবে না এখন!
তাহলে? রবিনও চিৎকার করেই বলল।
সামনে রাস্তা হয়তো ভাল, আশা করল কিশোর। ঝকির চোটে দাঁতে দাতে বাড়ি লাগছে তার।
গিয়ার নামানোর চেষ্টা করে দেখি, মুসা বলল।
ঘাম ফুটেছে মুসার কপালে। শক্ত করে চেপে ধরল স্টিকটা। দ্বিধা করল। পরক্ষণেই একটানে তৃতীয় গিয়ার থেকে নামিয়ে নিয়ে এল দ্বিতীয় গিয়ারে।
হঠাৎ এই পরিবর্তনে চাপ পড়ল ইঞ্জিনে, বিকট আর্তনাদ করে প্রতিবাদ জানাল। জোরে একবার দুলে উঠল গাড়ি, গতি কমে গেল।
খবরদার! চিৎকার করে উঠল রবিন, বাঁক! সামনে ডানে মোড় নিয়ে। পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে পথটা।
তীব্র গতিতে মোড় নেয়ার সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল তিনজনেই। বৃষ্টিতে ধুয়ে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে গাছের শেকড় বেরিয়ে আছে পাহাড়ের গা থেকে, লম্বা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে যেন চাকা আটকে গতি রোধ করতে চাইছে গাড়ির।
ডানে কাটল মুসা, পাহাড়ের দিকে।
কি করো! আঁতকে উঠে বলল রবিন।
পাহাড়ের গায়ে লাগিয়ে দিই! দেখি থামে কি না! জবাব দিল মুসা।
ঝটকা দিয়ে খাজ থেকে উঠে এল চাকা।
দেখো, আস্তে আস্তে! কিশোর বলল।
পথের কিনারে স্তূপ হয়ে আছে ধসে পড়া মাটি, ছোট ছোট পাথর। ঘ্যাঁচ করে ওগুলোর মধ্যেই ঢুকে গেল গাড়ি।
স্টিয়ারিং নিয়ে পাগল হয়ে গেছে যেন মুসা। হাত থেকে ছুটে যেতে চাইছে। বার বার। লাফাচ্ছে, ঝাঁকি খাচ্ছে, থরথর করে কাঁপছে পিকআপ।