নাচ চলছে। দরদর করে ঘামছে নাচিয়েরা। মেয়েরা আর বাচ্চারা নাচে অংশ। নিচ্ছে না, তারা বসে বসে দেখছে, মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে, গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। এর বেশি আর কিছু করণীয় নেই তাদের। বেশি অসুস্থ রোগীদেরকে মাদুরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কম্বল পাকিয়ে তাদের মাথার নিচে দিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আরাম করে শুতে পারে, আর মাথাটা কিছুটা উঁচু হয়ে থাকায় নাচ দেখতে সুবিধে হয়। বেশ জমজমাট উৎসব, আন্তরিকতার অভাব নেই।
একসময় শেষ হলো নাচ।
ঢাক বাজানো বন্ধ হলো। নর্তক এবং দর্শকেরা খাবারের দিকে এগিয়ে এল। তাড়াতাড়ি এসে খাবারের পাত্রের ওপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দিল মেয়েরা। কিশোর লক্ষ করল, নর্তকদের অনেকেরই চোখ লাল, কেউ কেউ কাশছে।
জনের চাচা মোড়ল আরেকজন বুড়ো মানুষকে নিয়ে হাজির হলেন। দুজনেরই পরনে উৎসবের পোশাক। লোকে যেভাবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে সরে। জায়গা করে দিচ্ছে বুড়ো মানুষটাকে, শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না এ লোকই গাঁয়ের শামান, গান গাওয়া ডাক্তার।
কথা বলতে বলতে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল দুজনে।
কাছে এসে থামল।
মোড়ল ডুম সবল ঘোষণা করলেন, তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারছি না। আমরা। একাই যেতে হবে তোমাদের। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।
.
০৮.
বেরোলে ঝুঁকিটা বেশি হয়ে যাবে, গান গাওয়া ডাক্তার বলল। অনুষ্ঠানটা নির্ভেজাল রাখতে হবে। অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের এখানে।
বুড়ো হতে হতে কুঁচকে গেছে শামানের মুখের চামড়া। যেতে পারছে না বলে সত্যিই দুঃখিত, এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তিন গোয়েন্দার। কিন্তু তার এই দুঃখিত হওয়ায় মিস্টার মিলফোর্ডের কোন উপকার হচ্ছে না।
তোমরা এখানে থেকে গেলেই ভাল করবে, পরামর্শ দিলেন মোড়ল ডুম সবল। কাল গাড়িতে করে দিয়ে আসা যাবে তোমাদের।
আজই যেতে হবে আমাদের, রবিন বলল। আমার বাবা নিশ্চয় ভীষণ বিপদে পড়েছে।
বিশাল এলাকা এটা, মোড়ল বলল। কল্পনাও করতে পারবে না কতটা বড়। ডায়মণ্ড লেক কি করে খুঁজে বের করবে?
রাস্তা ধরে যাব, মুসা জবাব দিল।
চল্লিশ মাইল হাঁটতে হবে তাহলে।
চল্লিশ মাইল! ঢোক গিলল মুসা।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। স্থির দৃষ্টিতে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। বলল, আপনাদের একটা পিকআপ ভাড়া নিতে পারি আমরা।
গাঁয়ে আসার পর এই প্রথম উজ্জ্বল হলো রবিনের মুখ। এই না হলে কিশোর পাশা! আসল কথাটা ঠিক তার মাথায় এসে যায়। অথচ এই সহজ কথাটাই মনে। পড়েনি রবিন কিংবা মুসার।
তাড়াতাড়ি রবিন বলল, আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।
টাকাও আছে, বলতে বলতে পকেট থেকে টাকা বের করে ফেলল রবিন। ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে খরচ করার জন্যে রেখেছিল। ভাড়া দিতে পারব।
আপনি যেখানে রেখে যেতে বলবেন, আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে সেখানেই রেখে যাব গাড়িটা, কিশোর বলল। খুব যত্ন করে চালাব, কিচ্ছু নষ্ট করব না। এই যে নিন, আমাদের কার্ড। লোকে আমাদের বিশ্বাস করে রকি বীচে। একটা উপকার চাইছি, করবেন না?
একটা করে তিন গোয়েন্দার কার্ড মোড়ল আর শামানের হাতে গুঁজে দিল কিশোর।
কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মোড়ল। শামান তাকালেনও না, তুলে দিলেন জনের হাতে। জোরে জোরে পড়ল জন।
মাথা নেড়ে মোড়ল বললেন, প্রস্তাবটা ভাল মনে হচ্ছে না।
ভ্রূকুটি করল গান গাওয়া ডাক্তার। তা ঠিক। তবে তাতে কোন ক্ষতি হবে না। প্রশংসার দৃষ্টিতে ছেলেদের দিকে তাকাল শামান। ঘোলা হয়ে আসা চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। এই তিনজন এমনিতেই চলে যাচ্ছে, থাকছে না, যা নিতে চায়। দিয়ে দিতে পারি আমরা।
ঠোঁট গোল করলেন মোড়ল। ব্যাপারটা তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু শামানের সিদ্ধান্তের ওপর কথাও বলতে পারেন না। বললেন, বেশ, ব্যবস্থা করছি। বলে খাবার খেতে বসা লোকগুলোর দিকে চলে গেলেন তিনি।
থ্যাংক ইউ, শামানের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ গলায় বলল রবিন।
বুড়ো মানুষটাও হাসল। একটা মুহূর্তের জন্যে নেচে উঠল তার চোখের তারা। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোকে নিয়ে এই এক অসুবিধে। সব সময় একটা না একটা গণ্ডগোল বাধাবেই, বিড়বিড় করে বলল সে। জনের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না?
আপনার কথা অমান্য করি না আমি, জন জবাব দিল।
কি করে এসেছ বলো ওদের, আদেশ দিল গান গাওয়া ডাক্তার। শোনাও।
তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বলল জন, দৈব আদেশ পাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলাম আমি। ভিশন কোয়েস্টে। চব্বিশ ঘণ্টা বনের ভেতরে ছুটে বেড়িয়েছি। কেবল প্রার্থনার জন্যে থেমেছি। রাতে ঘুমিয়েছি ঈশ্বরের নির্দেশ পাওয়ার জন্যে।
কি স্বপ্নে দেখলে, নাতি? জিজ্ঞেস করল শামান।
নাতি? সবাই তোমার আত্মীয় নাকি এখানে, জন? মুসার প্রশ্ন।
হেসে উঠল জন আর শামান।
আমরা এভাবেই বড়দের সম্মান জানাই, জন জবাব দিল। মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় সায় দিল শামান।
তার মানে মোড়ল তোমার চাচা নন, রবিন বলল।
না। আর শামানেরও আমি নাতি নই। তবে তিনি এখানে আমার বয়েসী সবার কাছেই দাদার মত।
মাথা ঝাঁকাল তিন গোয়েন্দা। বুঝেছে।
অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি আমি, দাদা, শামানের প্রশ্নের জবাবে বলল জন। শুরু হলো হ্রদ দিয়ে। দেখি, সবুজ একটা হৃদের ধারে গিয়ে পড়েছি আমি। ঝাঁপিয়ে পড়লাম তাতে। দাপাদাপি করতে লাগলাম। একটা মাছ আপনাআপনি এসে হাতে ধরা দিল। ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে। মাছটা দিয়ে চমৎকার খাবার হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। আরও অনেক মাছ এসে পড়তে লাগল আমার হাতের কাছে, এত বেশি, ধরলে হাতে রাখার জায়গা পাব না। ওরা কেবলই আমার গায়ে এসে পড়তে লাগল, আমার পিঠে, আমার বুকে, আমার মুখে লাফিয়ে পড়তে লাগল। আরও এল, আরও, আরও জোরে জোরে গুতো মারতে লাগল আমাকে। ঠোকর মারতে লাগল।