বিশাল এক রেডউড গাছের নিচে নিচু বেঞ্চিতে বসেছে ওরা। টেবিল হল বড় বড় কাঠের বাক্স। গায়ে লেখা রয়েছেঃ ইঞ্জিন পার্টস, জোনস ট্রাকিং কোম্পানি। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটা শেভ্রলে ট্রাক, বনেট তোলা। ইঞ্জিন খুলে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা বাক্সের ওপর। তার ওপাশে, বেশ কিছুটা দূরে টুয়ক, যেটাকে নদী না বলে বরং চওড়া বড় ধরনের নালা বললেই ঠিক হয়। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলকুল করে। টলটলে পানি। গভীরও বেশ।
উত্তরের বিশাল উপত্যকা থেকেই কি এসেছে ওই নদী? জিজ্ঞেস করল রবিন।
চেনো নাকি তুমি উপত্যকাটা? জনের কণ্ঠে সন্দেহ।
চিনি, মানে, সতর্ক হয়ে গেল রবিন। একটুকরো মাংস চিবিয়ে গিলল। দূর থেকে দেখেছি আরকি।
বাইরের কেউ যেতে পারে না ওখানে। ওটা পবিত্র জায়গা। আমরা ওর নাম দিয়েছি পূর্বপুরুষের উপত্যকা। জায়গাটা সংরক্ষিত করে রেখেছি আমরা। ইনডিয়ানদের গোরস্থান। মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠানও করি।
আমি যাইনি, জনকে নিশ্চিন্ত করল রবিন। আরেক টুকরো মাংস মুখে পুরল। তোমরা নিশ্চয় অনেক কাল ধরে আছ এখানে?
কি করে জানলে?
পাহাড়ে সিঁড়ি, দেখেছি আমি। বেয়ে ওঠার জন্যে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। ওখান দিয়ে উঠতে গিয়ে আরেকটু হলেই ধসের কবলে পড়েছিলাম। ধস না নামলে অবশ্য সিঁড়িটা দেখতে পেতাম না। অনেক কাল আগে কাটা হয়েছে।
হ্যাঁ, অনেক অনেক আগে এখানে এসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা, স্রষ্টা ওদের সৃষ্টি করার পর পরই। অজ্ঞান লোকেরা পাহাড়ে চড়তে চেষ্টা করলে ঈশ্বরই ধস নামিয়ে ওদের সরিয়ে দেন, কিংবা মেরে ফেলেন। তিনিই উইলো গাছ তৈরি করেছেন, যাতে আমরা বুড়ি বানাতে পারি, সেই ঝুড়িতে করে লাশ নিয়ে যেতে পারি উপত্যকায়। সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। হাসল জন। ওহহো, ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি তোমার বাবাকে খুঁজছ। ভেব না। গাঁয়ের বুড়ো জ্ঞানী লোকেরা সেটা বুঝবেন।
কিন্তু বাইরের মানুষের সমস্যা তারা বুঝতে চান না।
চান না, তার কারণ টুরিস্টদের পছন্দ করেন না তো। বড় বিরক্ত করে।
একটা কথাও বলেনি এতক্ষণ কিশোর। চুপচাপ খেয়েছে। পেট কিছুটা শান্ত হলে বলল, কিছু একটা ঘটছে নিশ্চয় এখন তোমাদের গায়ে।
ঘটছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে লোকে, জন জানাল। চোখ লাল হয়ে যায়, কাশি হয়, বুক ব্যথা করে। কারও কারও পেটে যেন আগুন জ্বালানো শয়তান ঢুকেছে। ভীষণ জ্বালাপোড়া করে পেটে। তাই জ্ঞানীরা ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে, ভয়াবহ ওই রোগ তাড়ানর জন্যে একটা উৎসব করা দরকার। গ্রাম থেকে বেরোনো নিষিদ্ধ। করে দেয়া হয়েছে। কাল দুপুরের আগে কেউ বেরোতে পারবে না।
ডাক্তারের কাছে যাও না কেন তোমরা? মুসার প্রশ্ন। রোগ হলে ডাক্তারই তো-..
মুসার পায়ে লাথি মারল কিশোর।
আউ করে উঠে থেমে গেল মুসা। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল।
একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল জন। মুসাকে হাসতে দেখে আরও অবাক হলো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। বলতে লাগল, তোমাদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদেরও তেমন ডাক্তার আছে। গান গাওয়া ডাক্তার, শামান। এখনকার যে শামান, আমার জন্মের। আগে থেকেই আছে, চিকিৎসা করছে বহু বছর ধরে। অনেক জানে, অনেক জ্ঞানী। মাঝে মাঝে অবশ্য বেকারসফিল্ডের ক্লিনিকে পাঠায় আমাদের, তবে সব সময় না। স্বাস্থ্যটাস্থ্য ভালই থাকে আমাদের, রোগ বালাই তেমন হয় না, আর হলেও অল্পতেই সেরে যায়। মানে যেত আরকি। এবারের অসুখটা আর সারতে চাইছে না। কয়েক মাস ধরে চলছে।
গা থেকে যে বোরোনো যাবে না বললে, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে রবিন, সেটা কি আমাদের বেলায়ও? জরুরী অবস্থায়ও কি বেরোনো যাবে না?
সেটাই শামানের কাছে জানতে গেছেন চাচা।
হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বাড়ল ক্ল্যাপ স্টিকের খটাখট। সম্মিলিত বিকট চিৎকার উঠল, মানুষের গলা থেকে যে ওরকম শব্দ বেরোতে পারে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন, ছড়িয়ে গেল গাঁয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।
নাচ আরম্ভ হয়েছে। অনেক বড় চক্র তৈরি করে নাচছে নর্তকেরা। কাঁচা চামড়ায় তৈরি মোকাসিন পায়ে থাকায় পায়ের শব্দ তেমন হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপার অবাক করল গোয়েন্দাদেরকে। চক্রের এক প্রান্তের লোকেরা যখন নাচছে, আরেক প্রান্ত চুপ থাকছে। কারণটা জিজ্ঞেস করল জনকে।
ও, জান না। বুঝিয়ে দিল জন, পৃথিবীটা হলো একটা নৌকার মত। পানিতে ভাসার সময় নৌকার এক পাশে যদি ভার বেশি হয়ে যায়, তাহলে কাত হয়ে যায়। আর সবাই একসাথে একপাশে চলে গেলে তো উল্টেই যাবে। সে জন্যে দুই দিকেই সমান ভার রাখতে হবে। নাচের বেলায়ও তাই। সবাই একধারে গিয়ে একসাথে নাচলে চলবে না।
তাহলে কাত হয়ে যাবে নাকি পৃথিবীটা? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল। মুসা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আবার লাথি খেল পায়ে। চোখের ইশারায়। বুঝিয়ে দিল কিশোর, যা বলছে চুপচাপ শুনে যাও না, এত কথা বলার দরকার কি?
ঘুরতে ঘুরতে কয়েকজন নর্তক এসে ঢুকে পড়ল চক্রের মাঝখানে। যতটা জোরে সম্ভব লাফাতে লাগল। যেন কার চেয়ে কে কত বেশি উঁচুতে উঠতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে।
এরও কারণ ব্যাখ্যা করে দিল জন, আগে একবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। তারপর আবার সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর। কাঠঠোকরার ওপর ভার দিলেন, কোথায় কেমন চলছে, সেই খবর নিয়মিত দিয়ে আসার। কাজেই আমাদের মধ্যে যাদের অন্তর খুব ভাল, ঈশ্বরের ভক্ত, তাদের রাখা হয়েছে কাঠঠোকরার অনুকরণ করার জন্যে। দেখছ না, মাথা আগেপিছে করছে কেমন ভাবে? কাঠঠোকরা ওরকম করেই গাছ ঠোকরায়, নিশ্চয় দেখেছ। কাঠঠোকরা যেভাবে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে গান গায়, ওরাও তেমন করেই গাইছে। এর কারণ জানো? কাঠঠোকরারা এই গান শুনতে পেয়ে ঈশ্বরকে গিয়ে খবর দেবে, এখানে কিছু মানুষের বড় দুর্ভোগ, অসুখ করেছে তাদের। ঈশ্বর শুনলে একটা ব্যবস্থা করবেনই। যাদের তৈরি করেছেন, তাদের তো আর কষ্টে রাখতে পারেন না। হয় রোগ সারিয়ে দেবেন, নয় তো শামানের ওপর ভার দিয়ে দেবেন, তাকে শক্তিশালী করে দেবেন যাতে মানুষের এই রোগ সারিয়ে দিতে পারে।