মাথা নেড়ে জন বলল, সরি, টেলিফোন নেই। এমনকি রেডিওও নেই। কোন জিনিসের প্রয়োজন হলে গাড়ি নিয়ে চলে যাই আমরা।
সবচে কাছের রেঞ্জার স্টেশনটায় নিয়ে যেতে পারবে?
এখন কারও বেরোনো চলবে না, পেছন থেকে বলে উঠল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ। জন, ছেলেগুলো কে?
ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। বিশাল চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল শরীর। চোখের মণি ঘিরে রক্ত জমে লাল একটা রিং তৈরি করেছে। মনে হয় মণিতে পানি টসটস করছে, নাড়া লাগলেই গড়িয়ে পড়বে।
চাচা, এদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম, জন বলল।
ওদের সঙ্গে কথা বলেছ?
জঙ্গলে বলিনি।
ভাল। জনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তার চাচা। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরতেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল মুখ, হাসিটা মিলিয়ে গেছে।
নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর, রবিন আর মুসা।
গাঁয়ের মোড়ল আর সর্দার শিকারি তার চাচা ডুম সবলের পরিচয় দিল জন।
আমার বাবা হারিয়ে গেছে। কি হয়েছে অল্প কথায় জানাল রবিন। তাড়াতাড়ি খুঁজতে বেরোনর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
চাচা, ডুমকে জিজ্ঞেস করল জন, ওদের কি সাহায্য করতে পারি আমরা?
উদ্বিগ্ন হয়ে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
সমস্যাই! বললেন মোড়ল। বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। কথা বলতে হবে।
যেমন নিঃশব্দে আচমকা এসেছিলেন ডুম, তেমনি করেই চলে গেলেন। আবার। হতাশায় কালো হয়ে গেল রবিনের মুখ।
জোর করে কিছুই করার উপায় নেই আমাদের। সান্ত্বনা দিয়ে জন বলল, গাঁয়ে পঞ্চায়েত আছে। শামান আছে। চুপ করে থাকো। আশা করি ভাল খবরই আসবে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। খুব একটা সান্ত্বনা পেয়েছে বলে মনে হলো না।
হ্যাঁ, তখন মুসার সঙ্গে কি যেন বলছিলে? আগের কথার খেই ধরল। কিশোর। ভিশন কোয়েস্টে গিয়েছিলে… জনের দিকে তাকাল সে। কি দেখতে? মোচড় দিয়ে উঠল ওর পেট। রান্না হচ্ছে কোথাও, সুগন্ধ এসে নাকে লেগেছে।
বলব, সবই বলব, জন বলল। আগে কিছু খেয়ে নাও।
নিশ্চয়ই! অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর, মুসার আগেই।
আসছি, বলে চলে গেল জন। খোলা জায়গাটার দিকে, যেখানে ঢাক বাজছে।
বাপরে বাপ! ভুরু কুঁচকে ইনডিয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা, চলে কি! হাঁটে না তো, মনে হয় পিছলে চলে যায়!
রবিন ওসব কিছু দেখছে না। তার একটাই ভাবনা। সাহায্য করবে তো ওরা?
তা করবে, যতটা জোর দিয়ে বলল কিশোর, ততটা আশা অবশ্য করতে পারল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, ঢাক বাজছে কেন।
তাড়াতাড়িই ফিরে এল জন। এসো। খাবার দেয়া হয়েছে। প্রথমে নাচব। আমরা, তারপর খাওয়া। সব শেষে অনুষ্ঠান। তোমরা আমাদের অতিথি, কাজেই তোমাদের আগেই খেয়ে ফেলতে হবে।
তোমরা পরে খাবে? রবিন বলল, সেটা উচিত না।
আমরাও অপেক্ষা করি, মুসা বলল। তোমাদের ফেলে রেখে একলা খাব, তা হয় না।
ঢোক গিলল কিশোর। এত খিদে পেয়েছে তার, অপেক্ষা করাটা কঠিন। তবু মুসার টিটকারি শুনতে চায় না বলে কোনমতে বলল, ঠিক। পরেই খাব।
জন হাসল। অত ভদ্রতার দরকার নেই। খাবার তৈরি। তোমাদেরও খুব। খিদে পেয়েছে, আমি জানি। আগে খেয়ে নিলেই বরং সম্মান দেখানো হবে। এটাই নিয়ম।
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
ওদের অপমান করা উচিত হবে না আমাদের, কিশোর বলল, কি বলো?
তাই তো মনে হচ্ছে, একমত হলো মুসা।
থ্যাংকস, জন, ভদ্রতা দেখাল রবিন। সে ভাবছে বাবার কথা। কোথায় কি ভাবে পড়ে আছেন কে জানে! খাওয়া নিশ্চয় হয়নি। ইস্, তাঁকেও যদি কেউ এখন। খাবার দিত!
জনের পেছন পেছন এগোল তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে গাঁয়ের লোক, বিশেষ করে বাচ্চারা। খোলা জায়গায় জমায়েত হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু। পুরুষদের খালি গা, মাথায় পাখির পালকের মুকুট, গলায় পাখির পালক আর পাথরে তৈরি মালা। মেয়েদের গলায় পুঁতির মালা। পুঁতি আর ছোট পাথর খচিত জামা পরেছে। ঢাকের সঙ্গে তাল রেখে দুটো করে কাঠি বাজাচ্ছে কয়েকজন লোক।
ওগুলোকে বলে ক্ল্যাপ স্টিক, জন বলল। বাজনার এখনও কিছুই না। জোর অনেক বাড়বে। এদিকে এসো। বাসন নিয়ে যার যার খাবার নিজেরাই তুলে নাও। খেতে খেতে দেখ। যেটা না বুঝবে, আমি বলে দেব।
বড় বড় কাঠের পাত্রে খাবার রাখা। বাঁশের তৈরি ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। সরিয়ে নিল মেয়েরা। কয়েক পদের ভাজা মাংস, আলু, সীম আর রুটি। খাবার দেখে এতটাই খুশি হল কিশোর, ভাবনাচিন্তা আর করল না, তুলে নিতে লাগল প্লেটে।
মুসা অতটা অস্থির হয়নি, খাবার দেখলে যে সব চেয়ে বেশি হয় সাধারণত। মাংসের একটা পাত্র দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, শুয়োর?
মাথা ঝাঁকাল জন। হ্যাঁ।
থমকে গেল কিশোর। একবার চিন্তাও করেনি, মাংসটা সুন্দর দেখে ওটার দিকেই হাত বাড়িয়েছিল নেয়ার জন্যে। আর কিছু নেই? হতাশ হয়েছে সে।
থাকবে না কেন? জন বলল, শুয়োর খাও না নাকি?
মাথা নাড়ল মুসা, কিশোর দুজনেই।
অসুবিধে নেই, জন আরেকটা পাত্র দেখিয়ে বলল, ওটা খরগোশ। আর ওটা কাঠবোলি। এগুলোও পছন্দ না হলে, একটা পাত্রের ঢাকনা তুলতে তুলতে বলল সে, মাছ নাও। অনেক আছে। টুয়ক থেকে ধরেছি। আমাদের ভাষায় টুয়ক বলে নদীকে।
হাসি ফুটল আবার মুসা আর কিশোরের মুখে। মাংস নিয়ে রবিনের কোন অসুবিধে নেই। সে শুয়োরও খায়।