কয়েকবার এরকম হলো। আরও একবার আগে চলে গেল মুসা। পথের বাঁকে হারিয়ে গেল। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল ওদের।
রবিন জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে, কিশোর বলল। আল্লাহ, ভাল কিছু যেন হয়! অ্যা
ই, আরেকটা রাস্তা!
যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব মুসার কাছে চলে এল অন্য দুজন। সরু আরেকটা কাঁচা রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসা। উত্তর-পুবের বন থেকে বেরিয়ে আবার দক্ষিণ-পশ্চিমের জঙ্গলে ঢুকে গেছে পথটা। জন্তু-জানোয়ারের পায়ের ছাপের মাঝে নতুন আরেকটা দাগ দেখতে পেল ওরা, গাড়ির চাকার দাগ।
কই, আকাশ থেকে তো দেখিনি পথটা? রবিনের প্রশ্ন।
এই এলাকায় আসার পর দেখার সুযোগই পেলাম কই?
কিশোর বলল। এখানকার আকাশে ঢোকার পর তো কেবল ভয়ে ভয়েই কাটিয়েছি, কখন আছড়ে পড়বে প্লেন।
রাস্তার এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ওরা। দুই ধারে প্রচুর গাছপালা ঝোপঝাড় আছে, দুটো গাড়ি পাশাপাশি পার হতে পারবে,, একটা ঢুকলে আর অর্ধেকটার জায়গা হবে বড়জোর।
ভাটির দিকেই যাই? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। নিচের দিকে গেলে হাঁটতে সুবিধে। শ্রান্ত পা চলতে চাইছে না। ওপরে ওঠা বড় কঠিন।
চলো, মুসাকে যেদিকেই যেতে বলা হোক, রাজি।
চলো, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? তাগাদা দিল রবিন। সাহায্য এখন ভীষণ প্রয়োজন ওদের। নিজেদের জন্যে যতটা না হোক, তার বাবাকে খোঁজার জন্যে বেশি।
নিচে নামাটা অনেক সহজ। প্রায় দৌড়ে নামতে লাগল ওরা। একটু পরেই দেখতে পেল তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে রাস্তাটা।
মাটি শুকনো, কঠিন। গভীর দাগ হয়ে আছে। শরৎকালে আর বুসন্তে বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়েছিল মাটি, তখন পড়েছে দাগগুলো, পরে রোদে শুকিয়ে ওরকম হয়ে গেছে।
পাশাপাশি হাঁটছে এখন ওরা। যেমন খিদে পেয়েছে, তেমনি ক্লান্ত। কথা প্রায় বলছেই না। এগিয়ে যাওয়ার দিকেই কেবল ঝোঁক। ডালে ডালে অসংখ্য পাখি দেখা যাচ্ছে। উড়ছে, বসছে, ডাকছে। ক্রমেই আরও, আরও ওপরে উঠছে সূর্য। গরম হচ্ছে রোদ।
খুব মৃদু প্রতিধ্বনির মত করে এসে কানে বাজল শব্দটা। থেমে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। কিসের শব্দ? কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে শব্দটা ভাল করে শুনে আবার এগোল। খানিক পরেই চিনতে পারল। অনেক মানুষের কথাবার্তা, কুকুরের ডাক আর ছেলেমেয়ের চিৎকার। বিচিত্র কলরব।
শহরের কোলাহল নয়। শহর বা গ্রাম যা-ই হোক, মানুষ তো! আশায় দুলে উঠল ওদের বুক।
চলার গতি আপনাআপনি বেড়ে গেল।
হাসি ফুটল রবিনের মুখে।
আরেকটা মোড় ঘুরে চওড়া হয়ে গেল পথটা। পথের মাথায় কতগুলো কাঠের পুরানো নরবড়ে কুঁড়ে। চারপাশ ঘিরে আছে রেডউড গাছ। কুঁড়ের বাইরে উঠানে পড়ে আছে মাছ ধরার আর শিকারের সরজ্ঞাম, মুরগীর খাবার দেয়ার গামলা। চারাগাছে তৈরি লম্বা ফ্রেমে, ঝোলানো রয়েছে চামড়া, শুকানর জন্যে। শরীর তোবড়ানো, পুরানো ঝরঝরে পিকআপ ট্রাক আর জীপ মরে পড়ে আছে যেন, কিংবা মরার প্রহর গুনছে।
ইনডিয়ানদের ছোট একটা গ্রাম। খেলা করছিল দুটো ছেলে, পরনে শার্ট, গায়ে টি-শার্ট। খেলা থেকে মুখ তুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দার দিকে। চোখ লাল, নাক থেকে পানি গড়াচ্ছে। ওদের পাশের বাদামী রঙের কুকুরটা লাফাতে লাফাতে ছুটে এল গোয়েন্দাদের জুতো শোকার জন্যে।
কি কারণে যেন খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে গাঁয়ের লোক। ছড়ানো একটা উঠানে জড় হতে আরম্ভ করেছে মহিলা আর বাচ্চারা।
দ্রিম দ্রিম করে বাজতে শুরু করল ঢাক।
অ্যাই, তুমি! আঙুল তুলে চিৎকার করে বলল মুসা, শোনো! দাঁড়াও!
একটা কুঁড়ের দিকে দৌড় দিল সে। চামড়ার ফতুয়া আর জিনস পরা এক ইনডিয়ান ছেলের কাঁধ খামচে ধরল এসে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছেলেটাকে ঘুরিয়ে ফেলল নিজের দিকে। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। জ্বলন্ত চোখে তাকাল সে মুসার দিকে। কঠিন, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে চেহারা।
তুমিই! জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল মুসা, হ্যাঁ, তোমাকেই দেখেছিলাম তখন! পিছু নিয়েছিলাম!
০৭.
কেমন লোক তুমি? অভিযোগের সুরে বলল মুসা। ছুটে পালালে কেন অমন করে?
কালো লম্বা চুল, চকচকে কালো চোখ, ঠোঁট সামান্য কুঁচকানো, সব মিলিয়ে ইনডিয়ান ছেলেটার চেহারা দেখলে ভয় লাগে। মুসাকে চিনতে পেরে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। নরম হয়ে এল মুখের ভাব। ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল।
এখানে এলে কি করে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। আমার পিছু নিয়ে?…না না, তা হতে পারে না।…যা-ই হোক পেয়ে তো গেছ। অবশ্য আবার ফিরে যেতাম তোমাদের কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাদেরকে ওভাবে ফেলে রেখে আসতে হলো। সরি।
এবার অবাক হওয়ার পালা মুসার। আসতে হলো মানে?
বলছি। গায়ের ফতুয়া টেনে সোজা করল সে। পুরানো হয়ে রঙ চটে গেছে জিনসের। কোমরের বেল্টের বাকলসটা খুব সুন্দর, সচরাচর দেখা যায় না ওরকম। রূপা দিয়ে তৈরি, ডিম্বাকৃতি, মাঝখানে বসানো একটা নীলকান্তমণি। বাকলসটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমি গিয়েছিলাম ভিশন কোয়েস্টে…
এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো রবিন আর কিশোর।
আমার নাম নরম্যান জনজুনস, ভদ্র গলায় নিজের নাম জানাল ইনডিয়ান ছেলেটা। আমি…
তোমাদের এখানে টেলিফোন আছে? বাধা দিয়ে বলল রবিন, ফরেস্ট সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। পাহাড়ের ভেতরে ভেঙে পড়েছে আমাদের প্লেন। আমার বাবা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজেছি, পাইনি।