এক চিলতে ভোলা জায়গা দেখা গেল। বিমানের ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল এই সময়।
হায় হায়, চলে গেল তো! খোলা জায়গাটার দিকে দৌড় দিল কিশোর।
অন্য দুজনও এল পেছনে। তিনজনেই হাত তুলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, নাচতে লাগল, বিমানটার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। অনেক ওপর দিয়ে উড়ছে ওটা।
হয়তো আমার জানে, অন্য দুচোখে পড়ার সম্ভাবনা
চিৎকার করতে করতেই পকেট থেকে একটানে ওর স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটটা বের করে খুলে নাড়তে লাগল মুসা। রবিন আর কিশোরও একই কাজ করল। জোরে জোরে ওপর দিকে লাফ মারতে লাগল রবিন। যে কোন ভাবেই হোক, বিমানটার চোখে পড়তে চায়। বাবাকে সাহায্য করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এই যে এখানে! আমরা এখানে! চেঁচিয়ে চলেছে।
আরে দেখো না, আমরা এখানে! বলল কিশোর।
কিন্তু বিমানটা ওদেরকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। একই গতিতে সোজা এগিয়ে যেতে লাগল। ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরও ছোট।
হয়তো আমাদের এস ও এস দেখতে পেয়েছে। আশা করল রবিন।
কিন্তু সে যেমন জানে, অন্য দুজনও জানে, অত ওপর থেকে ঘাসের মধ্যে তৈরি পাথরের এস ও এস-টা বিমানের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
আবার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল রবিন। এখানে আর সময় নষ্ট করতে চায় না। বাবাকে খুঁজে বের করতেই হবে!
অন্য দুজনেরও একই সংকল্প। বের করতেই হবে।
গুড়গুড় করে উঠল মুসার পাকস্থলী। কিশোরেরও একই অবস্থা।
হাই-ফাই স্টেরিও হয়ে গেছে পেট, রসিকতা করার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু নিমের তেতো ঝরল কণ্ঠ থেকে।
হাসল রবিন। বাজাতে থাক। কি আর করবে?
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা। ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরেছে। কয়েকটা পাইন। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে, বাঁয়ে।
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রবিনও তাকাল। ছায়ার ভেতরে ডাল নড়ছে। ওর বাবা না তো! মৃদু খসখস শব্দ হলো। অবশেষে দেখা গেল যে ডাল নাড়িয়েছে। তাকে। ছায়ায় ছায়ায় এগোচ্ছে। সাংঘাতিক হতাশ হলো রবিন। ওর বাবা নয়।
ইশারায় রবিন আর কিশোরকে ওখানেই থাকতে বলে রওনা হয়ে গেল মুসা। যেন পিছলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।
কি ভেবে দাঁড়াল না কিশোর। রবিনকে নিয়ে রাস্তা ধরে দ্রুত পা চালাল। মুসার সঙ্গে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করল। পাতায় ঘষা লাগার খসখস কানে আসছে। ওদের, মাঝে মাঝে চোখেও পড়ছে মুসাকে। কিন্তু যে লোকটার পিছু নিয়েছে, তাকে আর দেখতে পেল না।
তবে মুসা দেখতে পাচ্ছে। লোকটার সঙ্গে একই গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাছপালার আড়ালে আড়ালে। সেই লোকটাই, আগের দিন যাকে দেখেছিল, কোন সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে চলার চেষ্টা করছে সে।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বোধহয় সন্দেহ হলো লোকটার, শব্দটব্দ কানে। গেছে হয়তো। দেখে ফেলল মুসাকে। ঝট করে ডানে ঘুরে ঘন গাছের জটলার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। দৌড়াতে শুরু করল। আগের দিনের মতই খসাতে চাইছে।
কিন্তু আর ছাড়ল না মুসা। চোখের পলকে পেরিয়ে এল জটলাটা। যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অবাক হয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই বয়েসী একটা ইনডিয়ান ছেলে। চকচকে কালো চোখ।
চামড়ার ফতুয়া গায়ে, পরনে জিনস।
গাছের ঘন ছায়ায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। এতটাই চুপচাপ, মনে। হয় গাছ হয়ে যেতে চাইছে। গাছের সঙ্গে মিশে গিয়ে আত্মগোপনের একটা চমৎকার কৌশল এটা ইনডিয়ানদের। চট করে চোখে পড়ে না। মুখের একটা পেশী কাঁপছে না, এমনকি চোখের পলকও পড়ছে না।
ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে মুসার। বলল, এই, আমাদের সাহায্য দরকার…
জবাব দিল না ইনডিয়ান ছেলেটা। গোড়ালিতে ভর দিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল, তারপর নিঃশব্দে ছুটে ঢুকে পড়ল গাছের আরেকটা জটলায়।
পিছু নিল মুসা। দেখতে পাচ্ছে না আর ছেলেটাকে। গাছপালা যেন গিলে নিয়েছে তাকে। শব্দ না করে এত দ্রুত যে কেউ ছুটতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করত না মুসা।
ইতিমধ্যে থেমে থাকেনি কিশোর আর রবিন। রাস্তা ধরে এগিয়েই চলেছে। হাঁপাচ্ছে দুজনেই। শেষ যেন হবে না এই সীমাহীন পথ। বার বার তাকাচ্ছে ওরা। মুসাকে দেখার জন্যে। দেখতে পাচ্ছে না।
তারপর হঠাৎ করেই একশো ফুট সামনে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠল মুসা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ঘামে চকচক করছে কালো মুখ।
দৌড়ে কাছে এল কিশোর আর রবিন।
ওকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
কাকে?
ইনডিয়ান ছেলেটাকে?
কী? রবিন অবাক।
দেখেছি। হারিয়েও ফেলেছি। চলো।
বুনো পথ ধরে এগোল আবার তিনজনে। সামনে পাহাড়ের কারণে উঁচুনিচু হতে আরম্ভ করেছে পথ। চলতে চলতেই জানাল মুসা, কি হয়েছে।
তাহলে এদিকেই যাচ্ছিল সে! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন।
সামনে কি আছে আল্লাহই জানে,মুসা বলল।
বেশি সামনে যাতে যেতে না হয় আর! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। পা ব্যথা হয়ে গেছে!
মাটিতে বসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে নিল ওরা। তারপর আবার উঠে চলতে লাগল।
অনেক ওপরে উঠেছে সূর্য। গরম বাড়ছে। ডানা মেলে যেন ভেসে রয়েছে। প্রজাপতি। কিচ কিচ করে তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ছে নীল জে পাখি। বাতাসে পাইনের গন্ধ।
অধৈর্য, অস্থির হয়ে পড়ছে মুসা। সামনে চলে যাচ্ছে সে। রবিন আর কিশোর পড়ে যাচ্ছে পেছনে। ওদের এগিয়ে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। চিৎকার করে বলছে ওদেরকে তাড়াতাড়ি করার জন্যে।