.
০৬.
ঠাণ্ডা, শীতল সূর্য উঠল পর্বতের ঢালের ওপরে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। হাত ডলে, মাটিতে লাথি মেরে পা গরম করতে লাগল। আগুন নিভে গেছে। রাতে আর আগুনে কাঠ ফেলা হয়নি। তবে ঠাণ্ডা লাগেনি ওদের। স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট আর শার্টগুলো শরীর গরম রেখেছে।
যাক, আমরা ভাল থাকাতে, রবিন বলল, বাবার উপকার হবে।
অবশিষ্ট পপকর্নগুলো দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। ক্যাণ্ডি বাঁচিয়ে রাখল রাতের জন্যে। ঝোপের ওপর শুকানোর জন্যে ছড়িয়ে দিল ব্ল্যাঙ্কেট। বাড়তি মোজা আর শার্ট খুলে নিল থেকে।
সেসনা থেকে ছোট একটা নোটবুক হাতে বেরিয়ে এল রবিন। বন্ধুদেরকে দেখিয়ে বলল, এটা বাবার। প্রথম পাতায় কালকের তারিখ আর একটা লোকের নাম লেখা রয়েছে। হ্যারিস হেরিং। চেনো নাকি?
না, একসাথে জবাব দিল কিশোর আর মুসা।
ওর সঙ্গে দেখা করতেই বোধহয় যাচ্ছিল বাবা, অনুমান করল রবিন। তারিখটা ঠিক আছে। এই একটা নোটবুকই সঙ্গে এনেছে। বইটা পকেটে রেখে বিমান থেকে নেমে এল সে। তিনজনে মিলে রওনা হল তৃণভূমি ধরে পাহাড়ের দিকে।
গ্র্যানিটের দেয়ালে প্রথমে চড়ল রবিন। অন্য দুজনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। কোমরে হাত, চিবুক উঁচু, তাকিয়ে তাকিয়ে চারপাশের রুক্ষ, নির্জন পাহাড় দেখছে সে। বাবার নীল ক্যাপটা মাথায়। বয়েস আরও বেশি আর স্বাস্থ্য আরেকটু ভাল হলে রোজার মিলফোর্ড বলেই চালিয়ে দেয়া যেত তাকে।
ছড়িয়ে পড়ব আমরা, বলল সে। কাল রাতে আমি আর মুসা এখানে খুঁজেছি। আরও উত্তরে চলে যাব আমি, গাছগুলোর দিকে। তোমরা একজন বায়ে যাও, আরেকজন ডানে। এক ঘন্টা পর ফিরে এসে এখানে এই পিরামিডের কাছে মিলিত হব। ঠিক আছে?
তিনজনের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা। মিস্টার মিলফোর্ডকে ডাকতে ডাকতে চলল। মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে এরকম কোন জায়গাই দেখা বাদ দিল না।
অনেকখানি জায়গা নিয়ে খুঁজল ওরা। তারপর ফেরার জন্যে ঘুরল। তিনজনেই ভাবছে, অন্য দুজন হয়ত কিছু দেখতে পেয়েছে। ফিরে এল ওরা।
পিরামিড়টাকে আর দেখতে পেল না।
কোথায় গেল? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মুসা।
ধূসর গ্র্যানিটের ওপর ঘুরতে লাগল ওরা।
ছিল তো এখানেই, রবিন বলল।
না, মনে হয় ওখানে, মুসা বুলল।
দুজনেই ভুল করছ তোমরা, কিশোর বলল। এখানেই ছিল ওটা। গ্র্যানিটের গায়ে ওই যে গোল শ্যাওলার দাগ ওটা তখনও দেখে গেছি। এখান থেকেই রওনা হয়েছিলাম আমরা।
নিচু হয়ে একটা সিগারেটের গোড়া তুলে নিল সে। অন্য দুজনকে দেখিয়ে ৪ বলল, দেখ। কাগজটা কি রকম সাদা দেখেছ? তার মানে বেশি পুরানো নয়। আজ সকালে আমরা রওনা হওয়ার সময় এটা এখানে ছিল না। তাহলে চোখে পড়তই।
কি বোঝাতে চাইছ? মুসার চোখের পাতা সরু হয়ে এসেছে।
বোঝাতে চাইছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে রবিন বলল, কেউ এসেছিল এখানে। যে সিগারেট খায়। আমাদের চিহ্ন নষ্ট করেছে। হয়ত আমাদের ওপর নজর রাখতে এসেছিল, তিনজন তিনদিকে চলে যাওয়ায় পারেনি। একসাথে আর কজনের ওপর রাখবে। তাছাড়া গাছপালা ঝোপঝাড় তেমন নেই যে আড়ালে থেকে পিছু নেবে।
কিংবা হয়ত এমনিতেই ঘুরতে এসেছিল, সিগারেটের গোড়াটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে কিশোর। লম্বা ফিল্টারের সঙ্গে যেখানে সাদা কাগজ জোড়া দেয়া হয়েছে, সেখানে সরু একটা সবুজ রঙের ব্যাণ্ড। দামি জিনিস। গোড়াটা শার্টের পকেটে রেখে দিল সে।
সময় নষ্ট করা উচিত না, রবিন বলল। বাবা এখানে নেই। মুসা কাল যেখানে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখা দরকার। একজন লোককে দেখেছিল সে। হয়ত বাবাকেই দেখেছে।
আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, মুসা বলল।
কিন্তু হতে তো পারে। ভাল করে দেখনি তুমি। হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে। আবার কপালে ব্যথা পেয়েছিল বাবা। ফলে মাথার ঠিকঠিকানা ছিল না, তোমার। ডাক চিনতে পারেনি।
চিনতে পারুক বা না পারুক, জবাব দিল না কেন? শুনতে পাননি, এটা বলতে পারবে না।
এ কথার জবাব দিতে পারল না রবিন। বলল, একটা কাজ অবশ্য করতে পারি। কাকে দেখেছিলে, সেটা জানার চেষ্টা করা যায়। ফরেস্ট সার্ভিসের লোক হতে পারে। তাদের পেলে তো বেঁচেই গেলাম। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গায় খুঁজতে পারবে তারা। এখানকার বনও তাদের চেনা।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর আর মুসা। ঠিকই বলেছে। রবিন। ফরেস্ট সার্ভিসের লোক পেলে অনেক সহজ হয়ে যাবে খোঁজা। বুনন এলাকায় তল্লাশি চালানোর মত যন্ত্রপাতি এবং লোকবল আছে তাদের।
তাড়াহুড়ো করে ক্যাম্পে ফিরে এল ওরা। একেবারেই নিভে গেছে ক্যাম্পফায়ারের কয়লা। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তার ওপরে মাটি ছড়িয়ে দিল কিশোর। তৃণভূমির মাঝখানে পাথর সাজিয়ে বড় করে এস ও এস লিখল রবিন আর মুসা। যাতে ওপর দিয়ে গেলে বিমানের চোখে পড়ে। পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি পকেটে ভরল তিনজনে। পানির বোতলটা নিল রবিন।
স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটগুলোও নিতে হবে, মুসা বলল। আর ইমারজেন্সি কিটটা। বিপদে তো পড়েই আছি, আরও বাড়তে পারে। তৈরি হয়ে যাওয়াই ভাল।
মুসার সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নাড়ল কিশোর আর রবিন। রবিনের আফসোস হতে লাগল, ইস, তার বাবা যদি সাথে করে একটা স্পেস ব্লাঙ্কেট অন্তত নিয়ে যেতেন! ভাল হত।
উঁচু গাছের মাথার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকছে রোদের বর্শা, গোল গোল হয়ে এসে পড়ছে মাটিতে। পায়ে চলা সরু পথ ধরে একসারিতে এগিয়ে চলেছে ভিন গোয়েন্দা। আগের দিন এই পথ ধরেই গিয়েছিল মুসা। রবিনের মাথায় নীল টুপিটা পরাই আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলেছে কোথাও তার বাবার চিহ্ন আছে কিনা।