তোমার কি মনে হয়েছিল, সেটা কি আমরা জানি নাকি? হেসে ফেলল কিশোর।
দাঁড়াও, কি মনে হয়েছিল মনে করি…
হয়েছে, আর মনে করতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। প্যান্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আর তুমি টের পাচ্ছিলে না…
খাইছে! তুমি জানলে কি করে?
এতে জানাজানির আর কি আছে? ভূত দেখলেই তো তুমি প্রথমে ওই একটি কাজ করে ফেলো…
হাসল মুসা।
রবিনের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল।
সুযোগটা কাজে লাগাল কিশোর, বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গান, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী…
ওই গান থেকে যে কখন ওয়েস্টার্ন বাফেলো গালসে (গার্ল) চলে গেল। খেয়ালই রইল না। যখন খেয়াল হলো, দেখল তিনজনে গলা মেলাচ্ছে। বন্য রাতের আকাশ যেন ভরে দিল তিনটে কণ্ঠ, একেকটা একেক রকম। তিনজনের মাঝে রবিনের গলাই কেবল ভাল। মুসারটা খসখসে, আর কিশোরেরটা শুনলেই লেজ গুটিয়ে পালাবে নেড়ি কুকুর। একটা বাদ্যযন্ত্র হলে ভাল হয়। আর কিছু না পেয়ে দুটো ডাল তুলে নিয়ে ভুটানিদের মত একটার সঙ্গে আরেকটা পিটিয়ে শব্দ করতে লাগল মুসা। ওকে আর রবিনকে অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করল। গলা যেমন বেসুরো, পা-ও তেমনি বেতাল। বাজনা বাজানো আর হল না মুসার। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। রবিনও না হেসে পারল না। মনে দুর্ভাবনা না থাকলে তারও মুসার দশাই হত। তবে কিছুক্ষণ আগের মত আর ভার হয়ে নেই মন, অনেক হালকা হয়েছে।
মুসা গাইল, আর কয়েক রকমের নাচ নাচল কিশোর। ভুটানি, বাংলাদেশী খেমটা, আফ্রিকান আদিবাসীদের উন্মাদ নৃত্য, আর রক স্টারদের দাপাদাপি, কোনটাই বাদ রাখল না। শেষে ক্লান্ত হয়ে আগুনের ধারে বসে প্রায় জিভ বের করে। হাঁপাতে লাগল।
নাচের শেষ পর্যায়ে তার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যোগ দিয়েছে।
রাত হয়েছে। এবার শোয়া দরকার। সেই ব্যবস্থাই করতে লাগল তিনজনে।
মুসা বলল, গায়ের শার্ট খুলে নাও। ঘামে ভিজে গেছে। রাতে কষ্ট পাবে। খুলে শুকনো শার্ট যতগুলো আছে সব পরে নাও।
খুলতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। কিন্তু জানে, মুসা ঠিকই বলেছে। রাতে তাপমাত্রা আরও কমে যাবে, আর ওরা ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে যদি আগুন নিভে যায় তাহলে তো সাংঘাতিক অবস্থা হবে গায়ে কাপড় বেশি না থাকলে।
দ্রুত শার্ট বদলে নিল ওরা। তার ওপরে চড়াল জ্যাকেট। চেন টেনে দিয়ে মুসা বলল, মোজাও খোলো। ভেজা মোজা শরীরের তাপ শুষে নেয়।
জুতো খুলে মোজায় টান দিতেই দুর্গন্ধ বেরেতে শুরু করল। নাক কুঁচকে ফেলল তিনজনেই। মোজা বদলে জিনসের প্যান্টের নিচটা মোজার ভেতরে গুঁজে দিল। শার্ট জল প্যান্টের ভেতরে। মোটকথা বাতাস ঢোকার কোন পথই রাখল না।
রাতের জন্যে রাখা খাবার ভাগ করে দিল কিশোর। খুব সামান্য খাবার। কিছু পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি। ধীরে ধীরে খেল ওরা। তারপর ডালপাতা বিছিয়ে পুরু করে ম্যাট্রেস তৈরি করল।
পপকর্নের খালি প্যাকেটগুলো নিয়ে গিয়ে বিমানের ভেতরে রেখে এল মুসা। বলল, এসব ছড়িয়ে ফেলে রাখলে গন্ধে গন্ধে এসে হাজির হবে বুনো জানোয়ার। আর কিছু না পেয়ে শেষে আমাদেরকেই ধরে খাবে।
মাইলার স্পেস ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে আগুনের পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। ওরা। আগুনের নিচের অংশটা নীল, ওপরের কমলা রঙের শিখা যেন লকলক করে বেড়ে উঠে লাফ দিয়ে দিয়ে কালো তারাজ্বলা আকাশ ছুঁতে চাইছে।
চোখ মুদল ওরা। বিশ্রাম দরকার, আগামী দিনের পরিশ্রমের জন্যে। মিস্টার মিলফোর্ডকে খুঁজে বের করতে হবে।
হঠাৎ করেই কথাটা মনে এল কিশোরের। ঘুমজড়িত গলায় জিজ্ঞেস করল, রবিন, তোমার কন্ট্যাক্ট লেন্সের কি খবর? কবে খুলতে হবে?
কি একটা অসুবিধে দেখা দিয়েছে রবিনের চোখে। কন্ট্যাক্ট লেন্স পরার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার।
আরও হপ্তাখানেক পরে থাকতে হবে।
ও। তাহলে সময় আছে। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে সাতদিনের বেশি লাগবে না আমাদের। অসুবিধেয় পড়তে হবে না তোমাকে। সময় মতই গিয়ে খুলতে পারবে।
রবিন চুপ করে রইল। তিক্ত হাসি হাসল মুসা। নিঃশব্দে। আদৌ কোন দিন। এই দুর্গোম বুনো এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে কি-না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার।
ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে, ফলে গাঢ় হচ্ছে না ঘুম। রবিন ঘুমাতেই পারল না। চোখ খোলা। তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। তারা দেখছে। ওই যে বিগ ডিপার, ওটা উরসা মেজর, আর ওটা বাবা, কোথায় তুমি! প্রায় নিঃশব্দে ককিয়ে উঠল সে। ভেব না, বাবা, কোনমতে রাতটা কাটাও। কাল তোমাকে খুঁজে বের করবই আমরা!
চোখ মুদল অবশেষে রবিন। একটা পেঁচা কিরর কিরর করল। হউউ হউউ করল কোট। বনের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগল একটা বড় জানোয়ার। বহুদূরে পাহাড়ী পথে ট্রাকের ভারি ইঞ্জিনের শব্দ মৃদুভাবে কানে এল বলে মনে হল তার। রাতের বেলা শব্দ অনেক দূরে ভেসে যায়, আর অনেক সময় নীরবতার মাঝে থেকে নানা রকম অদ্ভুত কল্পনাও করতে থাকে মানুষ, ভুল শোনে…
ভারি হয়ে এল রবিনের নিঃশ্বাস। জেগে থেকে এখন রাবার কোন উপকারই। করতে পারবে না, বুঝতে পারছে। নিজের শরীরেই ক্ষতি করবে। তাতে পরোক্ষভাবে তার বাবার ক্ষতিই হবে, যদি কাল খুঁজতে বেরোতে না পারে সে। ধীরে ধীরে ঢিলে করে দিল শরীর। স্নায়ু ঢিল করতেই চেপে ধরল এসে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি। ঘুমিয়ে পড়ল। মুসা আর কিশোরের মতই তার ঘুমও গাঢ় হতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেই অবচেতন মনে একটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে, কোথায় রয়েছে সে?