মিলফোর্ডকে খোঁজার জন্যে আলাদা হয়ে দুদিকে সরে গেল মুসা আর রবিন। চিৎকার করে ডাকতে লাগল।
বাবা!
আঙ্কেল!
বাবা!
ঠাণ্ডা একঝলক জোরাল হাওয়া বয়ে গেল মালভূমির ওপর দিয়ে। কেঁপে উঠল রবিন। ওর বাবা কোথায়? ওদেরকে কিছু না বলে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা। নয়। যাবেন না।
চোখে পড়ল জিনিসটা। তার বাবার নীল ডজারস ক্যাপ।
বাবা! জোরে চিৎকার করে ডাকল আবার রবিন। দৌড়ে এল ক্যাপটার কাছে। পাশেই একটা ম্যানজানিটা ঝাড়। ঝড় তো নয়, যেন ঝাড়ের কঙ্কাল। বাবা! কাছাকাছি কোথাও রয়েছেন তিনি, অনুমান করল সে। কোথায় তুমি?
এই রবিন, পেলে নাকি কিছু? দৌড়ে আসছে মুসা।
কি পেয়েছে দেখাল রবিন। এই ক্যাপটার ওপর বাবার দুর্বলতা আছে। ফেলে যাওয়ার কথা নয়। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। খারাপ কিছু। জখম-টখম হয়ে এমনিতেই শরীর কাহিল, পাহাড়ে উঠে আরও খারাপ হয়েছে। মাথা ঘুরে কোথাও পড়ে আছে হয়ত। কিংবা পথ হারিয়েছে।
দেখি তো। ক্যাপটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল মুসা। কোন দুর্ঘটনায় মাথা থেকে পড়ে গেলে যেমন হয়, ছিঁড়ে যায়, ময়লা কিংবা রক্ত লেগে থাকে, সে রকম কিছুই নেই। ঠিকই তো আছে!
বাবা! আবার ডাকল রবিন।
অযথা ভয় পাচ্ছ। মাথা থেকে খুলে পড়ে গেছে। খেয়াল করেননি।
মাথা নাড়ল রবিন। অসম্ভব! মাথা থেকে ক্যাপ খুলে পড়ে যাবে আর খেয়াল করবে না এটা হতেই পারে না। তাছাড়া এটা তার লাকি ক্যাপ।
একটা পাথর কুড়িয়ে নিল মুসা। বলল, একটা পিরামিড বানাই। টুপিটা কোথায় পেলাম তার চিহ্ন। তুমি খোঁজা চালিয়ে যাও।
মাথা ঝাঁকিয়ে সরে গেল রবিন।
পশ্চিমে তাকাল মুসা। উজ্জ্বল কমলা রঙ হয়ে গেছে সূর্যটার। ডুবে যাচ্ছে। দ্রুত হাত চালাল সে। পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি করে চিহ্ন রাখা বনচারী মানুষ আর অভিযাত্রীদের একটা পুরানো কৌশল। বানাতে দেরি হল না। উঠে সে-ও খুঁজতে শুরু করল আবার। কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছে, সেটা রবিনকে জানাতে চায় না। তাহলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে বেচারার।
মুখের সামনে হাত জড় করে জোরে জোরে মিলফোর্ডকে ডাকতে লাগল দুজনে। চিৎকার বেরোতে না বেরোতেই সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, যেন পছন্দ না হওয়ায় ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চাইছে ওই শব্দকে। সব জায়গায় খুঁজতে লাগল ওরা। পাথরের আড়ালে, গাছের ছায়ায়, ভূমিকম্পে ফেটে যাওয়া গ্র্যানিটের খাজের ভেতরে।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মুসা বলল, ফিরে যাওয়া দরকার!
আরও পরে! উত্তরের বনের দিকে এগিয়ে চলেছে রবিন।
গিয়ে লাভ হবে না। এতক্ষণে নিশ্চয় ক্যাম্পে ফিরে গেছেন আঙ্কেল। আমাদের দেরি দেখলে রাগ করবেন।
না, যায়নি! রবিনের বিশ্বাস, কাছাকাছিই কোথাও রয়েছেন তার বাবা।
এই, শোনো, পথ হারাব আমরা। তাহলে আরও বেশি রাগ করবেন তিনি।
থেমে গেল রবিন। ঝুলে পড়ল কাধ।
সূর্য ডুবে গেছে দেখছ না, পাশে চলে এল মুসা। এখনও বাইরে ঘোরাফেরা করছেন না নিশ্চয় আঙ্কেল। চলো। গিয়ে দেখব, বসে আছেন। আমাদের জন্যেই দুশ্চিন্তা করছেন।
পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল রবিন। গোধূলীর বিচিত্র রঙে রঙিন হয়ে গেছে আকাশ। মুসার কথায় যুক্তি আছে, যদিও মানতে পারছে না রবিন। তার ধারণা, ফিরে যাননি তার বাবা। গিয়ে দেখবে নেই। তাহলে আবার বেরোতে হবে খুঁজতে। কিন্তু এই রাতের বেলা কি ভাবে কোথায় খুঁজবে? কাল সকালের আগে আর হবে না।
যেতে ইচ্ছে করছে না। নিরাশ হয়ে প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটতে লাগল। সে মুসার সঙ্গে। যেখান দিয়ে চূড়ায় উঠেছিল, চুড়ার সেই ধারটায় এসে থামল। নিচে তাকাল একবার। তারপর নামতে শুরু করল। বেগুনী আকাশ থেকে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে দিনের আলো। বিশাল একটা চাঁদ উঠছে, পূর্ণিমার বেশি বাকি নেই। আলো যথেষ্টই ছড়াবে, তবে এতটা বেশি নয় যাতে বনের ভেতর খোঁজা যায়।
তৃণভূমিতে নেমে শীতে কাঁপা শুরু করল ওরা। ছুটে চলল ক্যাম্পের দিকে। এতে শরীর গরম হবে, শীতটা একটু কম লাগবে। অন্ধকার হয়ে গেছে। আগুনের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল ওদের, চারপাশে কিছুদূর পর্যন্ত উষ্ণ একটা চক্র তৈরি করে জ্বলছে যেন আগুন।
মিলফোর্ডকে দেখা গেল না আগুনের পাশে। কিশোর একা।
পেলে না? জিজ্ঞেস করল গোয়েন্দাপ্রধান।
শুধু ক্যাপটা, জবাব দিল মুসা।
ধপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল রবিন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আগুনের দিকে।
মুসার চোখে চোখে তাকাল কিশোর। একটা ভুরু সামান্য উঁচু করল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল মুসা। রবিনকে সান্ত্বনা দিতে হবে এখন, ওর মন হালকা করার চেষ্টা করতে হবে।
এই, রবিন, আচমকা কথা বলল মুসা, শুনেছি, হট পিসটন নাকি সাংঘাতিক। যে ট্যালেন্ট এজেন্সিতে কাজ করে রবিন, সেখানকারই একটা নতুন রক গ্রুপ হট পিসটন। রবিনের খুব পছন্দ।
হ্যাঁ, ভালই, দায়সারা জবাব দিল রবিন।
আমিও শুনেছি ভাল, কিশোর বলল। যদিও গানবাজনা তার বিশেষ পছন্দ নয়, রবিনের খাতিরেই বলল। ওদের নতুন মিউজিকটা কি?
আমি জানি, মুসা বলল, লো দা গ্রাউণ্ড। দারুণ! আমার খুবই ভাল লেগেছে…।
শোনো, আমি বলি কি…
বাবার কথাই বলতে যাচ্ছে রবিন, বুঝতে পেরে তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেক কথায় চলে গেল মুসা, রবিন, বিশ্বাস করবে না, কি ভয়টাই না তখন পেয়েছি! লোকটা ভূতের মত এল, ভূতের মতই হারিয়ে গেল। বনের মধ্যে আমার মনে হয়েছিল-মনে হয়েছিল…কি জানি মনে হয়েছিল? মাথা চুলকাতে লাগল সে।