হাসতে লাগল মুসা। হো হো করে। পরিচিত একটা মানুষকে সামনে দেখে খুশি আর ধরে রাখতে পারছে না।
কি হয়েছে, মুসা? ওরকম করছ কেন?
জবাবে আরও জোরে হাসতে লাগল মুসা।
আরে কি হলো! পাগল হয়ে গেলে নাকি! ভুরু কুঁচকে বলল রবিন।
না! মাথা নাড়তে লাগল মুসা। আরও কিছু হো-হো-হো। না, পাগল হইনি। তোমাকে দেখে কি যে ভাল লাগছে!
কেন, আমাকে কি নতুন দেখলে নাকি?
নতুন না হলেও পরিচিত তো। ভূত নও যে গায়েব হয়ে যাবে।
এখানে আবার ভুত এল কোত্থেকে? আরও অবাক হয়েছে রবিন।
চলো, যেতে যেতে বলছি। তুমিও যখন এদিকেই আছ, তার মানে পথ ভুল করিনি। ঠিকই এগোচ্ছি। চলো।
হাঁটতে হাঁটতে সব কথা বলল মুসা।
ভূত? ভুল দেখনি তো? রবিন বলল।
না। ঠিকই দেখেছি।
হু! বনের ভূতে পেল শেষ পর্যন্ত তোমাকে, চিন্তিত ভঙ্গিকে বলল রবিন।
তোমার কথা বললে না? তুমি কি করে এলে? বলল রবিন।
ধস! বলো কি? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। পাহাড়ে যেখানে সেখানে। তো এভাবে ধস নামে না! ভাগ্যিস সরে যেতে পেরেছিলে! নইলে ভর্তা হয়ে যেতে!
আলোচনা করতে করতে চলল দুজনে। হঠাৎ হাত তুলে রবিন বলল, দেখো দেখো, কিশোর আমাদের চেয়ে আরামে আছে। কোন রকম বিপদে পড়তে হয়নি। তো। যা ধোয়া করছে, কাছাকাছি কেউ থেকে থাকলে চোখে পড়বেই।
মুসাও দেখতে পাচ্ছে। কালো ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে।
আগুনের কাছ থেকে কিছু দূরে বসে রয়েছে কিশোর। সূর্য ঢলে যেতেই শীত পড়তে আরম্ভ করেছে। জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে সে। চেন টেনে দিয়েছে একেবারে গলা পর্যন্ত। ধোয়া করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি। রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। আগুনের কুণ্ড ঘিরে ছয় ফুট জায়গার পচা পাতা, ঘাস আর পড়ে থাকা অন্যান্য জিনিস সাফ করেছে। লতাপাতা জোগাড় করে এনে রেখেছে বিছানা পাতার জন্যে।
কি ব্যাপার? মুসা আর রবিনের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। হাটুরে। কিল খেয়ে এসেছ মনে হয়? মুখ ওরকম কেন?
আমাকে দেখে খুশি হয়েছে মুসা, আরেক দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রবিন।
চোখ সরু হয়ে এল কিশোরের। মুসার দিকে দৃষ্টি স্থির। খুশির তো কোন লক্ষণ দেখছি না?
কি করলে লক্ষণটা বোঝা যাবে? রেগে গেল মুসা। দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে হবে?
না, তা বলছিনে। তবে মনে হচ্ছে ভূতের তাড়া খেয়ে এসেছ।
তা অনেকটা ওই রকমই, রবিন বলল।
জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসে আগুনের পাশে বসে পড়ল মুসা আর রবিনও। হাত সেঁকতে সেঁকতে বলতে লাগল কি করে এসেছে। বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়ছে এখন।
চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, বাবা কই?
ফেরেনি তো, কিশোর জানাল।
অনেক আগেই চলে আসার কথা, উদ্বিগ্ন হলো রবিন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বাবার কথা ভাবল। কপালের জখমটার কথা ভেবে উঠে দাঁড়াল সে। রওনা হয়ে গেল।
মুসাও উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াও, আমিও আসছি।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। এখানে বসে একজনকে ক্যাম্পের ওপর নজর রাখতেই হবে। নইলে বিপদ হতে পারে। দেখার কেউ না থাকলে অনেক সময় ক্যাম্পে ফায়ার ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের সৃষ্টি করে। মুসা আর রবিনের। সঙ্গে এবার যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে তার। মিস্টার মিলফোর্ডের জন্যে তারও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বসে থাকতেই হবে।
পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল মুসা। সূর্য ডোবার আর আধ ঘণ্টা বাকি। তার পরে আলো আর বেশিক্ষণ থাকবে না, ঝুপ করে নামবে অন্ধকার, এসব পাহাড়ী এলাকায় যেমন করে নামে।
পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল রবিন। তবে প্রপাতের ধারের পাহাড়ের মত দেয়ালের গায়ে এখানে খোঁচা খোঁচা পাথর বেরিয়ে নেই। পরতের পর পরত এ্যানিট এমন ভাবে পড়েছে, যেন পাহাড়ে চড়ার উপযুক্ত করেই। কোথাও কোথাও খুবই মসৃণ, প্রায় হাত পিছলে যাওয়ার মত, হাজার হাজার বছর আগে। বরফের ধস নামার সময় বরফের ঘষায় এরকম হয়েছে।
চূড়ায় উঠে এল দুজনে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে।
উৎকন্ঠিত হয়ে চারপাশে তাকাল রবিন। কই, গেল কোথায়? দেখছি না।
বসে আছেন হয়ত কোথাও। বিশ্রাম নিচ্ছেন, মুসা বলল।
নিচে শত শত মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে চড়াই উতরাই। ঘন বনে ছাওয়া। ডুবন্ত সূর্যের লম্বা লম্বা ছায়া পড়ছে বনের ওপর, এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। সবুজ বনের মাথায় লাল রোদ, যেখানে রোদ পড়তে পারেনি সেখানে গভীর কালো গর্তের মত লাগছে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সোনায় তৈরি। কিন্তু এসব দেখার আগ্রহ নেই এখন দুই গোয়েন্দার। ওরা যা দেখতে এসেছে সেই ফায়ার টাওয়ার কোথাও চোখে পড়ল না।
নজর ফেরাল ওরা। যেখানে রয়েছে পাহাড়ের সেই চূড়াটা দেখতে লাগল। লম্বা, গ্র্যানিটে তৈরি একটা মালভূমি। এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে বড় বড় পাথরের চাঙড়। পাথরের মধ্যেই যেখানে সামান্যতম মাটি পেয়েছে সেখানেই গজিয়ে উঠেছে কাঁটাঝোপ। রুক্ষ পাথরের মাঝে টিকে থাকার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। মালভূমির সবটাই দেখতে প্রায় একই রকম। কোথাও কোন বৈচিত্র নেই। উত্তরে আধ মাইল দূরে ঘন হয়ে জন্মেছে পাইন। আরেকটা জঙ্গল, এই মালভূমির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছে একটা শৈলশিরার কাছে, দ্বিগন্ত আড়াল করে দিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে আছে যেন শিরাটা। ওই শিরাটারই কোন প্রান্তে রয়েছে ডায়মণ্ড লেক।