হঠাৎ কি যেন নড়ে উঠল। টের পেল সে। পেছন থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওর দিকে। মানুষ, না জানোয়ার?
খসখস শব্দ কানে এল।
থমকে দাঁড়াল সে। কান পেতে রইল আরও শব্দের আশায়। সতর্ক হয়ে উঠেছে। আস্তে করে সরে চলে এল পথ থেকে, একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে তাকিয়ে রইল পথের দিকে।
এগিয়ে আসছে শব্দটা।
চলেও গেল এক সময়।
কিছুই দেখতে পেল না মুসা। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল তার। কি…কি ওটা!
অ্যাই! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে ডাকল সে। জানোয়ার হলে ডাক: শুনে ছুটে পালাবে। মানুষ হলে থামবে, দেখতে আসবে কে ডাকছে। অ্যাই, শুনছেন?
জবাবের আশায় রইল মুসা। কেউ দৌড় দিল না। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে পালাল না কোন জানোয়ার। সেই একই ভাবে খসখস শব্দ হয়েই চলেছে, মুসার ডাক যেন কানেই যায়নি।
শব্দের দিকে দৌড় দিল সে। কিছুদূর এগিয়ে গতি কমিয়ে কান পাতল শোনার জন্যে। আছে শব্দটা। থামেনি।
রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। মুখে লাগছে পাইন নীডল। কেয়ারই করল না মুসা।
আরেকটু এগিয়েই দেখতে পেল মূর্তিটাকে। মানুষ। গাছপালার ভেতর দিয়ে ঘন ছায়ায় থেকে হাঁটছে, ফলে ভাল করে না তাকালে চোখেই পড়ে না।
অ্যাই, শুনুন! জোরে চিৎকার করে ডাকল মুসা, দৌড় বন্ধ করেনি। শুনুন, কথা আছে! সাহায্য দরকার আমাদের!
দ্বিধা করল লোকটা। গতিও কমাল ক্ষণিকের জন্যে। পর মুহূর্তেই আরও বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল। হারিয়ে যেতে চাইছে গভীর বনের ভেতরে।
মুসাও গতি বাড়িয়ে দিল। কি ধরনের লোক? সাহায্যের কথা শুনেও থামেনি, বরং পালিয়ে যেতে চাইছে?
কয়েকটা গাছের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা।
ছুটতে ছুটতে গাছগুলোর কাছে পৌঁছে গেল মুসা। ঘুরে অন্য পাশে এসে তাকিয়েই থমকে গেল। নেই! উধাও হয়ে গেছে ভূতুড়ে মূর্তিটা। মানুষ? নাকি ভূতপ্রেত! গায়ে কাঁটা দিল তার।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। কান খাড়া। চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ। না শুনল আর কোন শব্দ, না দেখতে পেল লোকটাকে। গেল কোথায়? শুয়ে পড়ল না তো মাটিতে? ঘন ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেল?
আবার ডাক দিল সে, এই যে ভাই, শুনছেন! বিপদে পড়েছি আমরা! আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই! শুনছেন?
সাড়া নেই।
ও ভাই! আমি কিছু করব না আপনাকে…!
নীরবতা! খুঁজে বের করতেই হবে লোকটাকে, ভাবল মুসা।
খুঁজতে আরম্ভ করল সে। গাছপালার আড়ালে, ছায়ায়, ঝোপের ভেতরে।
মনে পড়ল সময়ের কথা। ঘড়ি দেখল। আরি, অনেক দেরি হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। কিন্তু কোনদিকে ফিরবে!
হায় হায়, কি গাধা আমি! নিজেকেই বকা দিল সে। পথটা যে কোথায়, কোন দিকে আছে, তা-ও বলতে পারবে না। উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসার সময় নিশানা রাখতেও ভুলে গিয়েছিল।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ভয়ে। কি বোকামিটা করেছে বুঝতে পারছে।
পথ হারিয়েছে সে!
.
০৫.
আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে মুসা। শান্ত হও, বোঝাল নিজেকে। মাথা ঠাণ্ডা করো। নইলে বিপদ থেকে মুক্তি পাবে না। আসতে যখন পেরেছ এখানে, যেতেও পারবে। কি করে যাবে কেবল সেইটাই ভেবে বের কর এখন।
আবার ঘড়ি দেখল সে। সরে চলে এল এমন একটা জায়গায়, যেখানে বন মোটামুটি পাতলা, গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে। এদিকে সরে ওদিকে সরে, এপাশে মাথা কাত করে ওপাশে মাথা কাত করে সূর্যটা দেখল সে। তারপর হিসেব শুরু করল।
তৃণভূমি থেকে রাস্তায় উঠে এসে দক্ষিণ পুবে রওনা হয়েছিল। রোদ পড়ছিল। তখন তার ডান কাঁধে। এখন নেমে গেছে সূর্য। উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার সময় তার বাঁ কাঁধের নিচের দিকে, প্রায় বুকে রোদ পড়ার কথা।
ঘন গাছপালায় ছাওয়া এই তরাই থেকে বেরিয়ে তৃণভূমিটা খুঁজে বের করা খুব মুশকিল। তবু, চেষ্টা তো করতে হবে।
সাবধানে হাঁটতে শুরু করল সে। বার বার মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যের দিকে। পাখি ডাকছে, গাছের পাতায় শিরশির কাঁপন তুলে বইছে বাতাস, ঝোপের ভেতর, হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জীব। পায়ের কাছ থেকে সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালি, ইঁদুর, লাফিয়ে উঠে ছুটে পালাচ্ছে খরগোশ।
এক ঘণ্টা ধরে হাঁটল সে। কোন কিছুই তো চিনতে পারছি না, নিরাশ হয়ে নিজেকে বলল। একটা চিহ্ন, একটা নিশানা দেখছি না যেটা দেখে বোঝা যায় ঠিক পথেই চলেছি।
আরও নেমেছে সূর্য। বড় জোর আর এক ঘণ্টা, তার পরেই ডুবে যাবে। এই সময় বনের ভেতরে আবার শব্দ শুনতে পেল সে। ডেকে উঠতে যাচ্ছিল আবার, সময় মত সামলে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। আগের বারও ডাকাডাকি করতে গিয়ে হুঁশিয়ার করেছে লোকটাকে, পালিয়েছে সে।
পা টিপে টিপে শব্দের দিকে এগোল এবার।
উত্তরে এগোচ্ছে সে। বাড়ছে শব্দ। লোকটা প্রথমবার যে রকম শব্দ করেছিল, তার চেয়ে বেশি লাগছে এখন।
থেমে গেল শব্দটা।
পাগল হয়ে গেলে নাকি! নিজেকে ধমক লাগাল মুসা। কোথায় তৃণভূমিটা খুঁজে বের করে নিরাপদ হবে, তা না, আবার এগিয়ে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে আরেকবার পথ হারানর জন্যে।
দ্বিধা করল সে। তবে একটা মুহূর্ত। তারপর আবার এগোল শব্দের দিকে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল, যেন ব্রেক কষে।
খাইছে! রবিন! চিৎকার করে উঠল সে।
ফিরে তাকাল রবিন। সে-ও চমকে গিয়েছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও, মুসা!