তাই তো! গাড়ির দিকেই নজর ছিল কেবল মুসার, আর কোনদিকে নয়। বরফের মত জমে গেল যেন সে। একটা মুহূর্ত। পরক্ষণেই দৌড় দিল সেদিকে।
পায়ের শব্দ শুনেই বোধহয় ফিরল লোকটা। মুসাকে দেখেই বনেট নামিয়ে গিয়ে টান দিয়ে খুলল ড্রাইভিং সীটের পাশের দরজা।
অ্যাই, শুনুন! দাঁড়ান! চেঁচিয়ে বলল মুসা।
কিশোর আর রবিনও ছুটতে শুরু করেছে তার পেছনে।
কিন্তু থামল না আর্মি জ্যাকেট পরা লোকটা। তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হয়ে গেল।
চোখের পলকে ঘুরে গেল মুসা। ছুটল তার নিজের গাড়ির দিকে। একটানে দরজা খুলে ভেতরে বসেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। সাঁই সাঁই করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে তুলে নিয়ে এল রাস্তায়। পিছু নিল পোরশের।
চল বেটা, জলদি কর, নিজের শিরোকোকে অনুরোধ করল মুসা। ওটাকে ধরা চাই। পালাতে না পারে।
কিন্তু মোড়ের কাছে পৌঁছে ব্রেক চেপেই বোকা হয়ে গেল সে। কিছুই হলো না। কাজ করছে না ব্রেক। প্যাডাল চেপে অযথাই পাম্প করে চলেছে সে, কিন্তু চাপ লাগছে না কোন কিছুতে।
পঞ্চাশ মাইল তুলে ফেলেছিল গতিবেগ। তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি সামনের চৌরাস্তার দিকে। ট্রাফিক পোস্টের লাল আলো জ্বলছে।
৬
একটা মুহূর্তের জন্যে প্যাডাল চাপা বন্ধ করছে না মুসা। কাজ তো করা উচিত! সে নিজে সব কিছু চেক করে। ব্রেক ফুইড ঠিক আছে কিনা নিয়মিত দেখে।
কিন্তু, কথাটা সত্যি, ব্রেক কাজ করছে না। কোনমতেই চাপ দিচ্ছে না চাকায়। গতিরোধ করার চেষ্টা করছে না। পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। ফলে গতি তো কমছেই না, আরও বাড়ছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চৌরাস্তায় গিয়ে পড়বে ভাগ্য ভাল হলে কোন গাড়ির গায়ে তো না লাগিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তবে লাগার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ লাল আলো জ্বলছে তার দিকটায়। অন্যদিকের গাড়িগুলো চলাচল করছে। ওগুলোর চালকদের জানার কোনই উপায় নেই যে মুসার গাড়ি ব্রেক ফেল করেছে।
মুসার মনে হচ্ছে তার গলার ভেতরে একটা আস্ত আপেল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বেরও করতে পারছে না, গলা দিয়ে নামাতেও পারছে না। ঘেমে ভিজে গেছে হাতের তালু।
কিন্তু মাথাটা এখনও ঠান্ডাই রেখেছে। ভেজা তালু দিয়ে চেপে ধরল গিয়ারশিফট নব। একটানে নামিয়ে নিয়ে এল ফোর্থ গিয়ার থেকে সেকেন্ড গিয়ারে। গতি কমানোর জন্যে। ইতিমধ্যে সামনের পোরশেটা মোড় নিল গতি না কমিয়েই। রাস্তায় ঘষা খেয়ে আর্তনাদ তুলল টায়ার। ঘুরে গেল গাড়িটা। দ্রুত সরে যেতে লাগল।
গতি কমছে শিরোকোর, তবে যথেষ্ট নয়। চৌরাস্তাটা আর মাত্র একশো গজ দূরে। হস হস করে বেরিয়ে যাচ্ছে ওপাশের গাড়িগুলো। এপাশের হলুদ সিগন্যাল এখনও জ্বলেনি।
জোরে হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করল একটা নীল হোন্ডা।
ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে মুসার হৃৎপিন্ড। গিয়ার আরও নিচে নামাল সে। তারপর চেপে ধরল হ্যান্ডব্রেক। একই সঙ্গে ডানে কাটল স্টিয়ারিং।
নিমেষে রাস্তা থেকে একটা শূন্য জায়গায় নেমে এল গাড়ি। কিছু বাড়িঘর উঠবে ওখানে, তারই প্রস্তুতি চলছে। মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। তাতে আরও কিছুটা গতি কমল গাড়ির। লম্বা ঘাসের ভেতরে পড়ে আছে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাব, সেগুলোতে ধাক্কা লেগে থেমে গেল শিরোকো।
প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগল। সীটবেল্ট বাঁধা না থাকলে উইওশীন্ডে গিয়ে বাড়ি লাগত মুসার মাথা।
মরতে মরতে বাঁচলাম! ভাবল সে। লম্বা দম নিতে লাগল নিজেকে শান্ত করার জন্যে। তারপর দরজা খুলে নেমে এল টর্চ হাতে। গাড়ির পাশে বসে পড়ে নিচে আলো ফেলে দেখতে লাগল ক্ষতিটা কোথায় হয়েছে। হুম, তাহলে এই ব্যাপার! ব্রেকের ফ্লুইড লাইন কাটা! ইগনিশন থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে। গোধূলি শেষ হয়ে অন্ধকার নামতে আরম্ভ করেছে তখন। স্যালভিজ ইয়ার্ডে ফিরে চলল সে।
দুই ক্যান সোডা ওয়াটার গেলার পর অনেকটা শান্ত হলো মুসার কাঁপুনি। হেডকোয়ার্টারের ট্রেইলারটা যে জঞ্জালের স্তুপের ভেতর লুকানো, তার বাইরে তিনটে পুরানো লোহার চেয়ারে বসেছে রবিন আর কিশোরের সঙ্গে।
যাক, কিশোর বলল। অবশেষে মিস্টার এক্সের দেখা মিলল।
ব্যাটা শয়তান, এখনও রাগ কমেনি মুসার। ব্রেকের লাইন ও-ই কেটে রেখেছিল। এমন ভান করছিল, যাতে আমি ওকে ফলো করি। কিংবা আমরা সবাই করি। এবং করলেই গিয়ে বাড়ি খাই পাহাড়ে।
তিন গোয়েন্দার নাম মুছে যেত তাহলে। কিংবা দুই গোয়েন্দা হয়ে যেত এতক্ষণে।
আমি ভাবছি, রবিন বলল। লোকটা কে? আমাদের পিছে লেগেছে কেন?
আর কি করেই বা জানল, যে আমরা তদন্ত করছি? যোগ করল কিশোর।
এটা আরেক রহস্য। পার্টিতে কিন্তু দেখিনি ওকে।
আর্মি জ্যাকেট পরা ওরকম কাউকে চেনে না জুন, মুসা বলল। তারমানে…
সে লারসেন পরিবারের কেউ নয়, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। কারও হয়ে কাজ করছে।
কার?
জবাব দিতে পারল না কেউ। তিনজনেই প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে ঘুমাল সে রাতে।
পরদিন সকালে ইয়ার্ডের গেটের বাইরে একটা অপরিচিত গাড়ি হর্ন দিতে লাগল, আর টেলিফোনটাও বেজে উঠল একই সঙ্গে। অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে কিশোর। ওসিলোস্কোপ দিয়ে ওর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছিল সে। ফোনের রিসিভার কানে ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। একটা রহস্যের সমাধান হলো। অপরিচিত হর্নটা মুসার গাড়ির। অচেনা, তার কারণ শিরোকোটা আনেনি মুসা। নিয়ে এসেছে আরেকটা, ওর মায়েরটা।