দরজায় জোরে জোরে দুবার থাবা দিল কিশোর। ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভেতরে কেউ আছেন? এপাশ ওপাশ একবার তাকিয়েই ঢুকে পড়ল শূন্য ঘরের ভেতরে। পেছনে ঢুকল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
এবার? জানতে চাইল মুসা, ওঘরে যাব কি করে? দেয়াল ফুটো করে?
তার দরকার হবে না, বলতে বলতে স্লাইডিং-গ্লাস ডোরের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। এখান থেকে হোটেলের ভেতর দিকে চত্বর আর সুইমিং পুল চোখে পড়ে। বাঁয়ে তাকাল সে। ৩১৮ নম্বর ঘরের ব্যালকনির দরজা রয়েছে চার ফুট দূরে। ছোট্ট একটা লাফ দিলেই পৌঁছে যাওয়া যায়, আনমনে বলল। তবে সেই লাফটা দেয়ার মত লোক প্রয়োজন, খেলাধুলায় যে পারদর্শী। বিশেষ করে ফুটবল প্লেয়ার।
না না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা। আমি পারব না!
তাকে রাজি করাতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগল না কিশোরের। ২২০ নম্বর ঘরের ব্যালকনির রেলিডে চড়ে বসল মুসা। বিড়বিড় করে বলছে, জ্বালিয়ে মারল! কিছু বলতেও পারি না! গাধার মত রাজি হয়ে যাই! কিশোরের দিকে তাকাল না। জানে, কি দেখতে পাবে। দেখবে, মুচকি হাসছে গোয়েন্দাপ্রধান। চোখে চোখ পড়লে হা হা করে হেসে ফেলবে। ওকে সেই সুযোগটা দিতে চাইল না।
কিন্তু রবিনকে ঠেকানো গেল না। হেসে বলল, দেরি করছ কেন? লাফ দাও। মাত্র তো চার ফুট।
তা তো বটেই, গজগজ করল মুসা। মাত্র চার ফুটই যদি কোনভাবে মিস করি, পড়ব গিয়ে তিরিশ ফুট নিচে।
শক্ত করে রেলিঙ চেপে ধরে আছে সে। বুড়ো আঙুলের ওপর ভর রেখে আচমকা হাত ছেড়ে দিল। চোখ সামনের ব্যালকনির দিকে। নিচে তাকাচ্ছে না। লাফ দিল অনেকটা ব্যাঙের মত করে।
অন্য ব্যালকনিটা যেন উড়ে চলে এল তার কাছে। ডান পা-টা রেলিঙে জায়গামতই বসল, কিন্তু পিছলে গেল বা পা। দম বন্ধ করা ভয়াবহ একটা মুহূর্ত, উল্টে পড়ছে সে। দুহাতে থাবা দিয়ে ধরে ফেলেছে রেলিং। চেপে ধরার ফলে সাদা হয়ে গেছে হাতের পেছনটা। ধীরে ধীরে টেনে তুলতে লাগল শরীরটাকে।
অনেক কষ্টে পতন রোধ করে আবার শক্ত হয়ে বসল রেলিঙে। লাফিয়ে নামল ব্যালকনিতে। ফিরে তাকাল বন্ধুদের দিকে।
অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত তুলে কাচ লাগানো দরজাটা দেখাল কিশোর। ঢোকার ইঙ্গিত করল।
বাহ্, চমৎকার, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা, আমার জন্যে খুব তো চিন্তা করো দেখছি!
দরজার কাছে গিয়ে কাচের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল সে। কাউকে দেখতে পেল। দরজা খোলার জন্যে নব ধরে টানতেই নিঃশব্দে খুলে গেল পাল্লা।
ভেতরে ঢুকল মুসা। ভাল মত দেখে নিল হুফার আছে কি-না ঘরে। নেই। অসংখ্য বোর্ডে আঁকা রয়েছে নানা রকম ড্রইং, সম্মেলনে বিক্রির জন্যেই নিশ্চয় একে রেখেছে হুফার। কিছু পত্রপত্রিকাও চোখে পড়ল। বেশির ভাগই কমিক ম্যাগাজিন। ওগুলোতে ফ্যান ফানের কপিটা দেখতে পেল না সে।
আলমারির দরজা খুলে দেখল ভেতরে আলখেল্লাটা আছে কি-না। তা-ও নেই। তারপর ড্রেসারে খুঁজতে এল মুসা। প্রথম ড্রয়ারটা সবে টান দিয়ে খুলেছে, এই সময় নড়াচড়া লক্ষ্য করল পেছনে।
ঝট করে সোজা হয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল সে। জমে গেল যেন বরফ হয়ে। বাথরুম থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা কুৎসিত মূর্তি। শরীরটা মানুষের মত, বিশাল চওড়া বুকের হাতি, পরনে কালো জিনসের প্যান্ট। মুখটা ভয়ঙ্কর। সবুজ রঙের একটা গিরগিটির মুখকে যেন বিকৃত করে দেয়া-হয়েছে। কমিকের ফ্রগ মিউট্যান্ট।
জীবটা যে মানুষ, সেটা বুঝতে সময় বেশি লাগল না মুসার। তবে যতটুকুই লাগল, তাতেই দেরি হয়ে গেল। মানুষটা লাফ দিয়ে সরে এল তার কাছে, ধা করে চোয়ালে ঘুসি মেরে বসল।
টলে উঠল মুসা। ঝটকা দিয়ে পেছনে সরে গেল মাথাটা, বাড়ি লাগল ব্যালকনিতে বেরোনর দরজার ফ্রেমে।
প্রচন্ড ব্যথায় যেন অন্ধ হয়ে গেল মুসা। ওই অবস্থায়ই কারাতের কোপ বসানর চেষ্টা করল লোকটার ঘাড়ে। লাগাতে পারল না। মারটা সহজেই ঠেকিয়ে ফেলল ফ্রগ মিউট্যান্ট, আবার ঘুসি মারল। পেছনে যেন উড়ে গেল মুসার শরীরটা, বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে।
ব্যালকনির রেলিঙে ধাক্কা খেল সে, তারপর উল্টে পড়তে শুরু করল। পাগলের মত হাত বাড়িয়ে রেলিং ধরার চেষ্টা করল, কিছুই ঠেকল না হাতে। চারিদিকে সব ফাঁকা, শুধুই শূন্যতা।
৪
মাথা নিচু করে নিচের চত্বরে পড়তে যাচ্ছে মুসা। মরিয়া হয়ে শূন্যেই শরীরটাকে বাঁকাল সে। বান মাছের মত শরীর মুচড়ে সরাসরি চত্বরে পড়া থেকে বাঁচল কোনমতে। ডাইভিং বোর্ড থেকে ঝাঁপ দিতে দিতেই এই কায়দাটা রপ্ত করেছে। সুইমিং পুলের দিকে সরে চলে এসেছে। নামছে তীব্র গতিতে। এই ডাইভ তাকে অলিম্পিকের স্বর্ণপদক এনে দেবে না, কিন্তু পদকের চেয়ে অনেক অনেক দামি জীবনটা তো বাঁচল।
ঝপাং করে পানিতে পড়ল মুসা। যতটা ডোবার ডুবে ভেসে উঠতে শুরু করল। ভুস করে মাথা তুলল পানির ওপরে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। কাঁপছে এখনও। অল্পের জন্যে বেঁচেছে। পুলের কিনার থেকে ডজনখানেক হাত এগিয়ে এল তাকে টেনে তোলার জন্যে। কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই রইল সে, শকটা হজম করে নেয়ার জন্যে।
আরেক গ্রহে নামল নাকি, ভাবছে মুসা। তার সামনের লোক-গুলোকে মনে হচ্ছে স্টার ওঅরস ছবির এক্সট্রাদের মত। রোবট, সবুজ মানুষ, মূল মাথা ছাড়াও আর দুটো বাড়তি মাথাওয়ালা মানুষ, আর বিচিত্র সব জীব। ওরাও আসলে মানুষ, এই সাজে সেজেছে।