দেয়াল ঘেঁষে প্রচুর বাক্স ছিল, দাগ দেখেই অনুমান করতে পারল কিশোর। মেঝেতে ধুলোর মাঝে মাঝে চারকোণ দাগ, ওসব জায়গায়ও বাক্স ছিল। র্যাকেও বই তেমন নেই। ব্যবসা খারাপ হয়ে এলে কিংবা দোকান বিক্রি করে দেয়ার সময় যে অবস্থা হয় সে রকম লাগছে। তবে বেশি তাড়াহুড়া যেন করেছে মালিক।
ঘুরে তাকিয়ে ডিকসনের ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। দোকানের পেছনের অংশে একটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। দোকান খালি হয়ে যাওয়ায় সুবিধেই হয়েছে ওদের। অনেক বাক্স সরিয়ে নিয়ে গিয়ে খোলা হয়েছে, বই বের করে নিয়ে বাক্সগুলো ওখানেই ফেলে রেখেছে। র্যাকের কমিক দেখার ভান করতে করতে ওখানে চলে এল কিশোর। হুফারও এল।
খুলে গেল সামনের দরজা, ভেতরে ঢুকল মিরিনা। পোশাকের মতই মুখেও হাসি ঝলমল করছে। কনভেনশন হলে যেভাবে আকৃষ্ট করেছে মানুষকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
এই-ই সুযোগ। মাটির নিচের ঘরে ঢোকার দরজাটা আস্তে করে খুলে ফেললেন ডিকসন। ঢুকে পড়ল তিনজনে। ধুলো পড়া চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে সিঁড়িতে, আলো-আঁধারি তৈরি করেছে।
নিচে নেমে সুইচবোর্ডটা খুঁজল কিশোর। পেল না। সিঁড়ির আলো আবছা ভাবে আসছে এখানে, তাতে ভাল করে জিনিসপত্র চোখে পড়ে না। তবে দেখার তেমন কিছু আছে বলেও মনে হলো না। কয়েকটা ছোট ছোট বাক্স আর খুলে রাখা কোন মেশিনের কিছু যন্ত্রপাতি বাদে।
যন্ত্রাংশগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। এরকম জিনিস দেখেছে কোথাও আগেও। কোথায়? ধীরে ধীরে স্মৃতিতে স্পষ্ট হলো। দেখেছে ওদেরই স্যালভিজ ইয়ার্ডে। বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ছাপাখানা থেকে কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা। কি মেশিনের জানেন? ফিসফিস করে বলল সে, পুরানো অফসেট প্রিন্টিং মেশিন। কিন্তু কি ছেপেছে ওরা এই মেশিন দিয়ে?
সামনে পা বাড়াতেই পায়ে লাগল দলামোচড়া করে ফেলে রাখা কাগজ। লাথি লেগে কাগজের বলটা ছুটে গেল হুফারের দিকে। তুলে নিল সে। টেনেটুনে সমান করল কাগজটা। দেখে বলল, এই ম্যাড, জানেন এটা কি?
সাদা-কালোয় ছাপা হয়েছে কাগজটাতে।
ডিকসনও দেখে চিনতে পারলেন। জানব না কেন? আগে খবরের কাগজে সাদা-কালোয় ছাপা হত কমিক। বইও ছাপত। এই পাতাটা নিশ্চয় পঞ্চাশ বছরের পুরানো।
আমার মনে হচ্ছে নতুন, পাতাটা দেখিয়ে বলল হুফার। পুরানো হলে হলুদ হয়ে যেত, কিনারগুলো হত ফাটা ফাটা। খোলার সময় মুড়মুড় করে ভেঙে যেত।
এখন বুঝতে পারছি, কিশোর বলল, স্পেশাল জিনিস বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে।
ভাল কথা, বলে উঠল একটা কণ্ঠ। এখন বলো তো, তোমাদের নিয়ে কি করা যায়?
সিড়ির দিকে তাকাল ওরা। আবছা আলোয় তিনটে মূর্তিকে দেখা গেল। নেমে আসতে লাগল একজন। তাকে চিনতে পারল কিশোর। কনভেনশন ফোরের সেই বিশালদেহী দারোয়ান।
মনে করেছিলাম, লোকটা বলল, তোমার কালো বন্ধুটা উড়াল দিয়ে পুলে নামার পর থেকেই সাবধান হয়ে যাবে। হলে না। ঘুরঘুর করতেই থাকলে, যাকে পেলে তাকেই প্রশ্ন করলে, আরও সহকারী জোগাড় করলে, শেষমেষ এখানেও এসে হাজির হলে। আশা করি, চেঁচামেচি করার কথা ভাবছ না। লাভ হবে না। দোকানটা বন্ধ করে দিচ্ছি আমরা। দেয়ালগুলোও অনেক পুরু। বাইরে থেকে শোনা যাবে না।
নরিস, বলল একজন সেলসম্যান, কণ্ঠে অস্বস্তি, কি করব এদের?
হ্যাঁ, লোকটার সঙ্গে গলা মেলাল কিশোর, কি করা হবে আমাদের? নরিস, জানলেন কি করে আমরা এখানে আসছি?
ওই বোরাম ছাগলটা লাফাতে লাফাতে এল বসের কাছে, তোমরা নাকি নানা রকম কথা জিজ্ঞেস করেছ, এটা বলার জন্যে। সে আন্দাজ করে ফেলেছিল, তোমরা এখানে আসছ। হাসল নরিস। তারপর আর কি? আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিল তোমাদের তিন গাধাকে ধরার জন্যে।
অন্ধকারে ভালমত আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, ভাবল কিশোর। ডিকসন আর হুফারকে মুসা আর রবিন বলে ভুল করছে ব্যাটা। ও, লুই মরগানের হয়ে অনেককেই ধরতে যান তাহলে আপনি, বলতে বলতে তার দিকে এগোল সে। আলোয় বেরিয়ে এল। পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে নেড়ে ইশারা করল ডিকসন আর হুফারকে, যাতে না এগোয়।
এখন আমার মনে পড়ছে, বলছে কিশোর, মুসা যখন ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়েছিল, তখন আপনি ছিলেন না গেটে পাহারায়। আপনার জায়গায় বসেছিল যে মেয়েটা হাতে সিল দেয় সে। ছুটি ছিল নাকি তখন আপনার? নাকি ছুটি দেয়া হয়েছিল আইজাক হুফারের ঘরে ঢোকার জন্যে?
ভয় পাচ্ছে কিশোর, তার কথা শুনে লোকটা মেজাজ না খারাপ করে বসে। সময় চাইছে সে। দেরি করিয়ে দিতে চাইছে। যাতে মুসা আর রবিন চলে আসার সময় পায়। ওপরে মিরিনারই বা কি হলো?
ডিনারের সময়ও আপনি ছিলেন ওখানে, কথা থামাল না কিশোর। বোরাম আর হুফার যখন হাতাহাতি শুরু করলেন, তাদের ছাড়াতে গেলেন। কেন? পরে সুযোগ করে গিয়ে হুফারকে শেষ করে দেয়ার জন্যে? নাকি বোরাম যে কাজটা করতে চেয়েছিলেন, সেটা করার জন্যে? বেচারা হুফারকে দুরমুজ করার জন্যে?
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল নরিস। এতক্ষণে বুঝলাম, তোমাদের নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন বস। মাথাটা বড় বেশি পরিষ্কার তোমাদের। অনেক কিছুই বুঝে ফেল।
তবে সব বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম, আপনিই বুঝি ক্রিমসন ফ্যান্টম সেজেছেন। পরে বুঝলাম, আপনি না। আপনার হাতের আঙুল বেশি মোটা, প্রায় চাঁপাকলার মত। সময় ফুরিয়ে আসছে, বুঝতে পারছে কিশোর। নরিস আর তার দুই সহকারী আর বেশিক্ষণ থাকবে না এখানে, কাজ সেরে সরে, পড়তে চাইবে।