এমনিতেই যথেষ্ট হয়েছে। ভারি বোঝা নিয়ে এলিভেটরের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতেই হাঁপিয়ে উঠল কিশোর।
কল বাটন টিপতেই খুলে গেল এলিভেটরের দরজা।
ঢুকল তিনজনে। পায়ের শব্দ কানে এল। দৌড়ে আসছে কেউ এলিভেটর ধরার জন্যে। ঝট করে একটা হাত ঢুকে গেল দরজার ফাঁকে, পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই। আবার ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। একজন লোক। শরীরের মাংস খসে খসে পড়ছে তার।
২
ভয়ঙ্কর মানুষটাকে দেখে আরেকটু হলেই হাত থেকে কমিকের বাক্স খসে পড়ে যাচ্ছিল কিশোরের।
লাফিয়ে এলিভেটরে উঠে লোকটা বলল, সরি, চমকে দিলাম। গোয়েন্দাদেরকে একধারে সরে যেতে দেখে হাসল। কাঁধের গিঁটলি হয়ে যাওয়া একটুকরো মাংস দুই আঙুলে টিপে ধরল সে। ল্যাটেক্স সেজেছি আমি। কমিকের মাংস খসা ভূত। প্রতিযোগিতার সাজ। কেমন লাগছে?
একেবারে বা-বাবা, তোতলাতে লাগল কিশোর, বাস্তব!
লবিতে পৌঁছল এলিভেটর। যেমন তাড়াহুড়ো করে উঠেছিল, তেমনি করেই নেমে গেল মাংস খসা ভূত। জনতার ভিড়ে হারিয়ে গেল। লবির আরও অনেকেই নানা রকম সাজে সেজেছে। সবই কমিক বইয়ের চরিত্র। এলিভেটর থেকে নেমে মারবেলের মেঝেতে বিছানো কার্পেটের ওপর দিয়ে ক্রোমের ফ্রেম করা অ্যানাউন্সমেন্ট বোর্ডের দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। ইনটারকমিকন, পড়ল কিশোর, মেইন কনফারেন্স হল। তাকাল দুই সহকারীর দিকে। অনেক বড় মনে হচ্ছে।
সম্মেলন যেখানে হবে সেদিকে এগোল ওরা। সাধারণ একটা কাঠের টেবিলের সামনে একদল মানুষকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। টেবিলের পেছনে বসে একটা মেয়ে। সোনালি রঙ করা চুল। মাঝখানে কালো রঙের একটা শিং গজিয়েছে, চুলগুলোকেই বাঁধা হয়েছে ওরকম করে। গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট, তাতে সাদা অক্ষরে লেখা: ইনটারকমিকন স্টাফ। তিন গোয়েন্দা কাছে যেতেই বলল, দশ ডলার করে প্রতিটি।
ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, কালো কালির বড় একটা ইঙ্ক প্যাড থেকে স্ট্যাম্পে কালি নিয়ে ছাপ দিয়ে দিল গোয়েন্দাদের ডান হাতের উল্টো পিঠে।
কিশোর লক্ষ করল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় রবিনের হাতটা ধরে রাখল মেয়েটা এবং এই প্রথম হাসল।
মুসাও ব্যাপরটা লক্ষ্য করেছে। কিশোরের দিকে মাথা কাত করে বলল, রবিনটা যে কি জাদু করে বুঝি না! মেয়েগুলো ওকে দেখলেই আরেক রকম হয়ে যায়…
যা খুশি করুকগে। হাতের ছাপটার দিকে তাকাল কিশোর। লেখা হয়েছেঃ ইন্টারকমিকন-ডে ১। বিড়বিড় করল সে, টিকেটের চেয়ে খরচ কম, ফাঁকিবাজিরও ভয় নেই। ইচ্ছে করলেই আমরা নিয়ে গিয়ে কোন বন্ধুকে দিয়ে দিতে পারব না এটা, টিকেট হলে যেমন পারা যায়। মোট কথা যাকে দেয়া হয়েছে শুধু তার জন্যেই এটা প্রযোজ্য।
রবিনের পেছন পেছন কনফারেন্স হলের দরজায় এসে দাঁড়াল দুজনে। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী এক লোক। ষাঁড় যেন। এর গায়েও কালো টিশার্ট। হাত বাঁড়াল টিকেট চাওয়ার ভঙ্গিতে।
যার যার ডান হাত বাড়িয়ে দিল তিন গোয়েন্দা।
ছাপগুলো পরীক্ষা করল লোকটা। তারপর হাসল। বেরিয়ে পড়ল একটা ভাঙা দাঁত। সরে গেল একপাশে। পা বাড়াল তিন গোয়েন্দা। ঢুকল এসে যেন এক সাংঘাতিক পাগলখানার মধ্যে।
লবির শান্ত পরিবেশের তুলনায় এই জায়গাটাকে মনে হলো আরব্য রজনীর কোন সরগরম মেলা, কিংবা বাজার। বিশাল হলঘরে পাতা হয়েছে কাঠের শত শত ফোল্ডিং টেবিল। কিছু টেবিল ব্যবহার হচ্ছে কাউন্টার হিসেবে, রাশি রাশি কমিকের বই স্তূপ হয়ে আছে ওগুলোতে। কিছু টেবিলে গায়ে গায়ে লাগিয়ে স্টল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি স্টলের পেছনে লাগানো হয়েছে তাক আর ডিসপ্লে বোর্ড, ওগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রঙচঙে কমিকের বই। বইগুলোকে যত্ন করে অয়েল পেপারে মোড়া হয়েছে। সংগ্রাহকের জিনিস। যার পছন্দ হবে অনেক দাম দিয়ে কিনবে।
অনেক মানুষ। যেখানে ফাঁক পেয়েছে গাদাগাদি করে রয়েছে। হাঁটার উপায় নেই। অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে এগোতে হয়। বুড়ো-বাচ্চা, সব বয়েসের মানুষই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কমিকের ওপর, দামদর করছে। পছন্দ হলে কিনছে, না হলে সরে যাচ্ছে আরেক কাউন্টারে। বিচিত্র সব পোশাক পরে রয়েছে অনেকে, ক্রেতাবিক্রেতা উভয় দলেই আছে এই সাজের বাহার। হট্টগোলে কান ঝালাপালা।
পাথর হয়ে যেন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তিন বন্ধু। লম্বা, পাতলা লাল চুলওয়ালা, ইনটারকমিকনের টি-শার্ট পরা একজন মানুষ সরে এলেন ভিড়ের ভেতর থেকে। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
প্রথম এলে বুঝি, বললেন তিনি। তোমাদের অবাক হওয়া দেখেই বুঝেছি। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ইনটারকমিকনে স্বাগতম। আমি লুই মরগান। এই কনভেনশনের চীফ। হাসলেন। পাগলাগারদ মনে হচ্ছে তো? কিশোরের হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তো, কি নিয়ে এলে?
ওদের কথা শোনার পর হাসিটা বাড়ল তাঁর। অনেক পাইকার পাবে এখানে। হাত ছড়িয়ে স্টলগুলো দেখালেন তিনি। সব চেয়ে বড় গ্রুপটা হলো সুমাতো কমিকস। তাদের টাকা আছে, ভাল দাম দিতে পারবে। ওই যে, ওদিকটায় ওদের স্টল। লম্বা একটা আঙুল তুলে ঘরের একধারে দেখালেন।
নির্দেশ মত ঘরের ওই পাশটায় চলে এল তিন গোয়েন্দা। ছোট একটা স্ট্যান্ডের কাছে এসে থামল কিশোর, কমিকের সাথে সাথে টি-শার্টও বিক্রি হয় ওখানে। তিনজনের জন্যেই একটা করে শার্ট কিনল সে। ওগুলোতে ছাপ মারা রয়েছেঃ কমিক লাভারস ডু ইট উইথ পিকচারস।