আর চেষ্টা করল না কিশোর। লাভ নেই। পারবে না। অহেতুক পরিশ্রমে ক্লান্ত হওয়ার কোন মানে হয় না। তাছাড়া ক্লান্ত হলে মগজও ঠিকমত কাজ করতে চায় না। ভেসে থেকে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
পানি থেকে উঠে পড়ল মেয়েটা। চুলে আঙুল চালিয়ে পানি ঝরাল, তারপর গিয়ে বসল একটা লাউঞ্জ চেয়ারে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে লাগল। কয়েক ডলা দিয়ে তোয়ালেটা রেখে দিয়ে হেলান দিল চেয়ারে। আরাম হচ্ছে না বোধহয়। আবার উঠে চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে রোদের দিকে মুখ করে বসল।
চেয়ারের হেলানে ঝোলানো ছিল ব্যাগটা। নাড়া লেগে মাটিতে পড়ে গেল। মুখ খুলে ছড়িয়ে পড়ল ভেতরের জিনিস। লক্ষ্যই করল না মেয়েটা। সে রোদ নিয়ে ব্যস্ত। কিভাবে ঠিকমত গায়ে লাগে সেটা দেখছে।
কিশোর তাকিয়ে রয়েছে ব্যাগ থেকে বেরোনো জিনিসগুলোর দিকে। কমিকের বই। অনেকগুলো।
খুবই অবাক হয়েছে সে। কি করবে ঠিক করতে পারল না একটা মুহূর্ত। ডুব দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে নিল যেন। তারপর সাঁতরাতে শুরু করল তীরের দিকে। পানি থেকেই দেখতে পেল কমিকগুলোর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড। না না, একটা নয়, আরও আছে! আশ্চর্য! ওদের কমিকের বই আর কার্ডগুলো তো থাকার কথা হোটেলের ঘরে, একটাও তো বিক্রি করেনি এখনও। তাহলে মেয়েটা পেল কোথায়?
এর একটাই মানে হতে পারে। এই কমিক ওদের ঘরেরগুলো নয়। ম্যাড ডিসনের স্টল থেকে যেগুলো ছিনতাই হয়েছে সেগুলো। বাক্সে অনেক কার্ড ছিল। কিছু ঢুকে গিয়েছিল হয়তো বইগুলোর মাঝে।
কিন্তু মেয়েটার কাছে এই জিনিস এল কোথা থেকে?
১০
ভূতে তাড়া করেছে যেন, এমন তাড়াহুড়ো করে পানি থেকে উঠে এল কিশোর। তার কাণ্ড দেখে অবাক হলো মেয়েটা। পিঠ সোজা করে বসে তাকিয়ে রইল।
পানিতে নড়াচড়া করছিল বলে ততটা ভাল করে মেয়েটাকে দেখতে পারেনি কিশোর। এবার দেখল। বড় বড় চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। রোদে শুকানোর পর চুলের রঙও আরেক রকম হয়ে গেছে। বাদামী নেই আর এখন, সোনালি।
মিরিনা! বলে উঠল কিশোর, তুমি এখানে কি করছ?
চারপাশে তাকাল মিরিনা। অপরাধী অপরাধী একটা ভাব। অনুনয়ের সুরে বলল, বলো না, প্লীজ। আমি ভেবেছিলাম কেউ দেখতে পাবে না…
চেয়ারের পায়ের কাছে পড়ে থাকা কমিকগুলোর দিকে তাকাল আবার কিশোর। কেন বলব না?
ওর হাত চেপে ধরল মিরিনা। প্লীজ! জানলে আম্মা আমাকে খুন করে ফেলবে!
এটা আশা করেনি কিশোর। চুপ করে রইল।
আবার বলল মিরিনা, এত সকালে কেউ আসবে এখানে কল্পনাও করিনি। কাজেই ভাবলাম, এই সুযোগে চট করে একবার সাঁতারটা দিয়েই আসি। আম্মা জানতে পারলে…
চোখ মিটমিট করল কিশোর। কিসের কথা বলছ?
ওর সোনালি পরচুলাটার কথা। বিচ্ছিরি জিনিস! খোলার সুযোগ পেলেই খুলে রাখি। এই ফালতু জিনিস কে মাথায় দিয়ে বেড়ায়! ভাবলাম, এভাবে কেউ চিনতে পারবে না আমাকে। ভুল করেছি।
আরও সোজা হয়ে বসতে গিয়ে চেয়ারের একেবারে কিনারে চলে এল সে। তুমি ডুবে ছিলে, তাই পানিতে নামার আগে দেখতেই পাইনি তোমাকে। আশা করি, কাউকে কিছু বলবে না, আমাকে বকা শোনাবে না। কি আর করব! কপালটাই খারাপ! পড়লাম তো পড়লাম, একেবারে গোয়েন্দার সামনে!
মুখ তুলে তাকাল মিরিনা। কিশোরের চোখে চোখ। দৃষ্টিতে অনুনয়। আম্মা যদি শোনে, আমি এই কাণ্ড করেছি, ভীষণ রেগে যাবে। স্টেলারা স্টারগার্লের মডেল হওয়া আর কোন দিনই হবে না হয়তো আমার। আম্মা সাহায্য না করলে…
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, শোনো, আমি এসেছি জিজ্ঞেস করতে, এগুলোর ব্যাপারে।
মাটি থেকে ব্যাগ আর কমিকগুলো কুঁড়িয়ে নিয়ে মিরিনার দিকে বাড়িয়ে ধরল
সে।
এগুলো…! বইগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মিরিনা, এগুলো এখানে এল কিভাবে!
আমিও সেটাই জানতে চাই, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর।
ওগুলো আমার নয়! আজব কমিকগুলো দেখে প্রথমে অবাক হলো মিরিনা। কার্ডগুলো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, এই ভেবে যে কমিকের মালিকের নাম লেখা রয়েছে। তারপর রেগে গেল যখন দেখল কার্ডে কিশোরের নাম লেখা রয়েছে। এগুলো তো তোমাদের! তোমাদের কার্ড এর মধ্যে গুজে দিয়েছে! আমাকে ভয় দেখালে কেন…!
থেমে গেল আচমকা। গোল গোল হয়ে গেল চোখ। সর্বনাশ! শুনেছি তোমাদের কমিকও চুরি হয়েছে। এগুলো নয় তো?
চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। এটা যদি অভিনয় হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে মিরিনার অসকার পাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। তবে এতটা বাস্তব অভিনয় করতে পেরেছে বলে মনে হলো না তার। সত্যি কথাই বলছে মেয়েটা।
হ্যাঁ, এগুলোই আমাদের চুরি যাওয়া কমিক, কিশোর বলল। তিনশো ডলার দাম উঠে গেছে। তোমার ব্যাগে এল কি করে?
হেলান দিল মিরিনা। বিস্ময় রয়ে গেছে চোখে। কোলের ওপর রাখা হাতের আঙুল মুঠো হয়ে গেছে। বলল, আমি জানি না। জোর নেই গলায়।
কি বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে মিরিনা। এখন আর কেবল মায়ের বকা শুনেই পার পাবে না, আরও দুর্গতি আছে কপালে। সে চোর, এটা জানাজানি হলে ক্যারিয়ার শেষ। মডেলিঙের এখানেই ইতি।
আবার মুখ তুলে তাকাল মিরিনা। বিধ্বস্ত চেহারা। মেকআপ নেই বলেই যে ওরকম লাগছে, তা নয়।
এটা তোমার ব্যাগ, তাই না? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।