একটা রয়াল পাম গাছের কাছে আসতেই ছায়ার মধ্যে গুঙিয়ে উঠল কে যেন। মাটিতে পড়ে ছিল। উঠে বসল কোনমতে। পাতলা, রাগী চেহারা। চিনতে অসুবিধে হলো না। এডগার হুফার।
কি হয়েছে আপনার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ঠোঁট ফুলে গেছে হুফারের। মুখের একপাশে কাটা দাগ। চোখের কোণে কালশিটে পড়ে গেছে। ভ্রূকুটি করে মুখ বাঁকাতে গেল সে, সাধারণত যা করে, উফ করে উঠল ঠোঁটে ব্যথা লাগতে।
কি হয়েছে বলতে পারব না। ওই হট্টগোল ভাল্লাগছিল না, তাই বেরিয়ে এসেছিলাম খোলা বাতাসে। কে জানি এসে পড়ল গায়ের ওপর। উঠে দাঁড়াল হুফার। ব্যথার ভয়ে আস্তে আস্তে খুব সাবধানে নড়াচড়া করছে। ভালমত পেটাল আমাকে সে। চেহারা দেখার সুযোগ পেলাম না। তবে কে, আন্দাজ করতে পেরেছি।
কে? জানতে চাইল রবিন।
কে আমাকে পেটাতে চেয়েছিল? ঘুসি মেরেছিল হলঘরে? হোটেলে ঢোকার গেটের দিকে পা বাড়াল হুফার। নীল বোরাম।
ভেতরে ঢুকল হুফার। পেছনে তিন গোয়েন্দা। ছেলেদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে আর্টিস্ট, ওদের পোশাক অবাক করেছে তাকে।
রিসিপশন ডেস্কের দিকে ঘুরতে গেল রবিন। মাথা নেড়ে তাকে মানা করল কিশোর, আপাতত চাবির কথা ভুলে যাও।
হুফারকে অনুসরণ করে লৰি ধরে চলল ওরা। নজর সামনের দিকে। আশেপাশে কারও দিকে তাকাচ্ছে না। মুখ টিপে হাসছে লোকে, টিটকারি দিচ্ছে, মন্তব্য করছে ওদের উদ্দেশে। এলিভেটরের কাছে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা।
চারজনেই এলিভেটরে উঠলে তিন নম্বর লেখা বোতামটা টিপল হুফার।
সম্মেলনের বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই হচ্ছে দোতলার ঘরগুলোতে, হুফার বলল। আরও ওপরে উঠছে কেন, সেটা জানাল সে, নীল বোরামের ঘরের নম্বর তিনশো পঁয়তিরিশ। শুনে ফেলেছি। ওর সঙ্গে দেখা হওয়া প্রয়োজন এখন আমার। মুঠো হয়ে গেল তার আঙুল।
এলিভেটর থেকে নেমে বারান্দা ধরে এগোল সে। পেছনে ছায়ার মত লেগে রইল তিন গোয়েন্দা।
৩৩৫ নম্বর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাবা দিল হুফার।
ভেতর থেকে সাড়া দিলেন বোরাম। দরজা খুললেন। টাইয়ের নট ঢিলা করা। সুট এখনও পরাই রয়েছে।
সোজা কলার চেপে ধরল হুফার। ঝাঁকাতে শুরু করল। চিৎকার করে বলল, ভেবেছ পার পেয়ে যাবে! সেটি হচ্ছে না!
আরি, হুফার, করো কি! করো কি! চেঁচিয়ে উঠলেন বোরাম।
ভেতর থেকে ডাক শোনা গেল। দুজনকে ছাড়ার চেষ্টা করতে লাগল তিন গোয়েন্দা। দৌড়ে এলেন লুই মরগান। পেছনে কয়েকজন লোক, কমিকের কোন কোন কাজ করে সবাই, হাতে গেলাস।
কি করি! ব্যাঙ্গ ঝরল হুফারের কঠে। এখনই বুঝবে! তোমার চেহারাটাকে আরেক রকম করে না দিয়েছি তো আমার নাম হুফার না! আমারটাকে যেমন করেছ!
কি…কি বলছ তুমি…কিছুই তো বুঝতে পারছি না! গলায় চাপ, দম নেয়ার জন্যে হাঁসফাঁস করছে বোরাম, কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
ন্যাকা! বুঝতে পারছ না! মুখ ভেঙচাল হুফার। আমার গায়ের ওপর এসে পড়েছিলে কেন? মারলে কেন?
বোরাম কিছু বলার আগেই মরগান জিজ্ঞেস করলেন, কখন মারল?
এই তো কয়েক মিনিট আগে! ওকেই জিজ্ঞেস করুন না!
মাথা নাড়তে লাগলেন মরগান। কি করে গেল? ওর ঘরে আমরা এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হলো। বেরোয়নি। আমাদের দাওয়াত করে এনেছে।
পার্টি চলেছে, কিশোর মুখ খুলল এবার, কাজেই সবার চোখ এড়িয়ে চট করে বাইরে থেকে ঘুরে আসাটা অসম্ভব নয়।
হয়তো। জোর দিয়ে বললেন মরগান, কিন্তু গত আধ ঘণ্টায় যে বেরোয়নি এটা আমি বলতে পারি। ঘরের মাঝখানের বড় একটা কাউচ দেখিয়ে বললেন, ও আর আমি ওখানে বসে ছিলাম এতক্ষণ। কথা বলছিলাম।
সরাসরি কিশোরের চোখের দিকে তাকালেন তিনি। বাইরে বেরোলে আমার চোখ এড়িয়ে কিছুতেই যেতে পারত না।
৯
পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল কিশোর। ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে তখনও রবিন আর মুসার, ঘুমোচ্ছে। শব্দ করল না সে, ওদের ঘুম ভাঙাল না। ব্যাগ থেকে সাঁতারের স্যুটের একটা পাজামা বের করে পরল। গায়ে দিল একটা ঢোলা শার্ট। চাবি নিয়ে পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে।
পুলের কিনারে যাওয়ার জন্যে বেরোচ্ছে। তার ধারণা, ওখানে এই কেসটা নিয়ে ভাবলে জবাব মিলবে তাড়াতাড়ি। মগজটা ভালমত কাজ করবে ওখানে গেলে।
পুলের পানিতে নেমে পড়বে। চুপ করে ভাসতে ভাসতে মনটাকে ছেড়ে দেবে বল্গাহীন ভাবে-যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াক। জট ছাড়াক রহস্যগুলোর। আজব এক জটিলতার মধ্যে পড়েছে। এক পা এগোলে দুপা পিছিয়ে আসতে হচ্ছে।
যেমন ধরা যাক আইজাক হুফারের কথা। লোকটাকে কাছে থেকে দেখলে তার সম্পর্কে অন্য একটা ধারণা হয়ে যায়। ওর রাগী রাগী ভাবটা আর ততখানি থাকে না। রাগী, সন্দেহ নেই, তবে হাস্যকর একটা ব্যাপারও রয়েছে ওর মাঝে, কিছুটা ভাঁড়ামি। ওকে চোর হিসেবে কিছুতেই ভাবতে পারছে না কিশোর।
শুধু তা-ই নয়, রাতে ওদের ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে, এটাও মানতে পারছে না। একটা ব্যাপার আলোচনা করে তিনজনেই একমত হয়েছে, যতটা জাপটাজাপটি ওরা করেছে ধরার জন্যে, তাতে আর যা-ই হোক, হুফারের চেহারার ওই পরিবর্তন হতে পারে না, ওভাবে মারেইনি ওরা। তাহলে ওসব দাগ কার কাছ থেকে সংগ্রহ করল হুফার?
সন্দেহ অন্য দিকে ঘোরানর জন্যে নিজেই নিজেকে পেটায়নি তো? নাহ। ভ্যানে করে লোকটা পালিয়ে যাওয়া আর তিন গোয়েন্দার ওকে দেখে ফেলার মাঝে এতটা সময় পায়নি সে যে এরকম একটা কাণ্ড করতে পারবে।