হাত ওল্টাল মুসা। কয়েকজন আর্টিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। ওরা জানিয়েছে, ওখানে তখন ছিল না হুফার।
তাহলে হুফারকেও কিছু প্রশ্ন করা দরকার আমাদের, পরামর্শ দিল রবিন।
আগে খেয়ে নিই, চলো, কিশোর বলল।
চলো।
টেবিলে বসে গেছে ডুফার। তিন গোয়েন্দাকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। খাবারের চেহারা দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কিশোরের। সালাদটা তো সহ্য করা যায়, কিন্তু মুরগীর যা চেহারা-নিশ্চয় সেদ্ধ হয়নি ঠিকমত, রবার হয়ে আছে। আলুগুলোও পোড়া।
রবিনের কানে কানে বলল মুসা, কিছু বলো না। পয়সা তো আর দিতে হবে আমাদের। মুফতে পেয়েছি। যা পেলাম খেয়ে নেয়া ভাল।
খাওয়ার পরে হুফারের সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করেছিল তিন গোয়েন্দা, সেটা সম্ভব হলো না। দেখা গেল, ডিনার শেষের বক্তা হিসেবে তাকেই বেছে নেয়া হয়েছে।
উঠে দাঁড়াল হুফার। আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে, সে জন্যে প্রথমেই মিস্টার মরগানকে ধন্যবাদ দিয়ে নিচ্ছি। হাসল সে। ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার পর এই প্রথম আমাকে এতটা গুরুত্ব দিল কেউ।
তার উদ্দেশ্যে মৃদু হাসল শ্রোতারা।
আমি জানি, কিছু লোকের ধারণা, আমি এখানে এসে কমিক তৈরি একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। মাথা নাড়ল হুফার। ভুল। তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। নতুন একটা হিরো তৈরির কাজে হাত দিয়েছি আমি। খুব তাড়াতাড়িই সেটাকে দেখতে পাবেন আপনারা।
কেউ হাততালি দিয়ে, কেউবা কথা বলে তার এই কাজকে স্বাগত জানাল।
কার হয়ে কাজ করছেন আপনি? জিজ্ঞেস করল একজন।
সেদিক ঘুরল হুফার। আমি আমার নিজের হয়ে ছাড়া আর কারও জন্যে কাজ করি না। অন্তত এখন। এবার আমার কমিক আমি নিজেই পাবলিশ করব। এতে অনেক ঝামেলা হয় বটে, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর, নীল বোরামের দিকে তাকাল সে। হাতছাড়া হওয়ার ভয়ও থাকে অনেক কম। ঠকিয়ে নেয়ার কেউ থাকে না তো।
জ্বলন্ত চোখে আর্টিস্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সম্পাদক। তার চকচকে টাকের চামড়া লালচে হয়ে উঠেছে।
নিজে পাবলিশ করার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল হুফার। বক্তৃতা শেষে উৎসাহী অনেক ভক্ত তুমুল করতালি আর চিৎকার-চেঁচামেচি করে আনন্দ প্রকাশ করল। জানাল, তার নতুন হিরোর আশায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করবে তারা।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে এক টেবিলে বসে মাথা দোলাল ডুফার। হুফার নতুন কমিক তৈরি করছে একথাটা আমার কানেও এসেছিল। যাক, সত্যিই করছে তাহলে। খুশি লাগছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়িতে আঙুল চালাতে লাগল সে। ভাবছি, পাবলিশ করার টাকা পেল কোথায়?
আমার বিশ্বাস, কিশোর বলল। সেজন্যেই এখানে এসেছে সে। টাকা। জোগাড়ের জন্যে।
অনেক টাকা দরকার। পাবলিশিং মুখের কথা নয়।
আইজাক হুফারের ব্যাপারে আরেকটা প্রশ্ন জমা হলো! বিড়বিড় করল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ডাকাতির সময়কার কোন অ্যালিবাই নেই হুফারের। এখন মনে হচ্ছে, ডাকাতি করার একটা উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে তার। মোটিভ? তা মোটিভটা হলো, টাকা।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। হাই তুলছে গোয়েন্দা সহকারী। কেমন লাগছে তোমার, বুঝতে পারছি, কিশোর বলল। আপাতত হুফারের সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়ে ঘুমোতে যাই চলো।
তা-ই চলো, রবিন বলল।
মুসা তো রাজি হয়েই আছে। আমিও চলে যাব এখুনি, ডুফার বলল।
তাকে গুড নাইট জানিয়ে রওনা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
পথে একটা টেবিলে আবার দেখা হলো মিরিনার সঙ্গে। সাথে তার মা রয়েছেন এবং বরাবরকার মতই টেবিলের অন্যান্য লোকদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন হয়ে আছেন।
ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল মিরিনা।
কিশোরের মনে হলো, হাসিটা বোধহয় রবিনের উদ্দেশেই। মনে মনে হাসল সে। রবিনকে বড় বেশি পছন্দ করে মেয়েরা।
তবে সেকথা মুহূর্তে ভুলে গেল কিশোর। তার মন জুড়ে রয়েছে কেসটার নানা প্রশ্ন, নানা রকম সমস্যা। বিছানায় শুয়েও ভাবতেই থাকল সে। ঘুম আসছে না। একটু পরেই কানে এল দুই সহকারীর নাক ডাকার শব্দ।
হোটেলের অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছে কিশোর। একসময় মনের পর্দায় ভেসে উঠল মিরিনা জরডানের মুখ। মনে হতে লাগল, মেয়েটা মেয়েটা সত্যিই এসবে জড়িত নেই তো? থাকতেও পারে…
ভাবনায় ছেদ পড়ল তার। খুট করে একটা শব্দ হলো দরজায়। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল কিশোর।
কে যেন দরজা খুলে ঢোকার চেষ্টা করছে!
৮
খুলে গেল দরজা।
একটা ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেল কিশোর। আবছা আলোয় লোকটাকে চিনতে পারার আগেই পেছনে লেগে গেল পাল্লা। ঘরে ঢুকেছে লোকটা।
বিছানার পাশের টেবিলের দিকে ঝটকা দিয়ে চলে গেল কিশোরের হাত, টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টেপার জন্যে। কিন্তু অপরিচিত ঘরে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে সব ভন্ডুল করে দিল। নাড়া লেগে উল্টে পড়ে গেল ল্যাম্পটা।
কি! কি হয়েছে! চিৎকার শুরু করল রবিন আর মুসা, জেগে গেছে।
ঘরে লোক ঢুকেছে, মুসা টের পেল প্রথমে। লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে ধরতে গেল ওকে। অন্ধকারে শুরু হয়ে গেল জাপটাজাপটি।
কিশোরও নেমে পড়েছে। ঘুসি মারতে গিয়েও সামলে নিল। সরিয়ে আনল হাত। কার গায়ে লাগবে ঠিক নেই। রবিন কিংবা মুসার গায়েও লাগতে পারে। দ্বিধায় পড়ে গেল সেজন্যে।
কিন্তু লোকটার সেই অসুবিধে নেই। যাকেই মারবে, যার গায়েই লাগবে, সেই শত্রু। কাজেই এলোপাতাড়ি মেরে চলল সে, আর মারতে লাগল গায়ের জোরে।