খাওয়ার পর-পরই দুই সহকারীকে বলল, চলো, হেঁটে আসি। বেশি খেয়ে ফেলেছি, হজম করা দরকার।
রবিন আর মুসা দুজনেই বুঝল ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায় গোয়েন্দাপ্রধান। কোন প্রশ্ন না করে ওর সাথে চলল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে চলে এল লেকের ধারে ছোট একটা বনের কাছে। ঢুকে পড়ল ভেতরে।
বনের ভেতরে একটুকরো খোলা জায়গা দেখে সেখানে ঘাসের ওপর বসল। মিস্টার সাইমনকে যে ফোন করেছিল সেকথা জানাল কিশোর। পকেট থেকে বের করল প্রশ্নের জবাব লেখা কাগজটা।
দেখে দেখে বলল, বারোদের শ্রবণশক্তি খুব প্রখর। তবে কুকুরের মত চালাক নয়। গন্ধ শুকে চিনতে পারে না। কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারে। কাউকে পছন্দ করলে তার ভীষণ ভক্ত হয়ে যায়। কণ্ঠ শুনলে সাড়া দেয়।
তারমানে, রবিন বলল, তোমাকে যে পছন্দ করেছে শারি, সেটা সারাজীবনই এক রকম থাকবে? মুচকি হাসল সে।
রেগে গেল কিশোর। বাজে কথা বন্ধ করো তো!..হ্যাঁ, যা বলছিলাম। এই গাধাটার জন্যেই ওই ক্রসওয়ার্ড পাজলের ব্যবস্থা করেছিলেন ডজ। এমন একটা কণ্ঠস্বর খুঁজছিলেন, যেটা একটা বিশেষ মানুষের কণ্ঠের সঙ্গে মিলে যায়। হবে কোন আমেরিকান, আমাদের বয়েসী, যে গাধাটাকে ভালবাসত।
পিরেটো কি বলেছে জানিয়ে বলল সে, সেই মানুষটা বারোটার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সে কে জানি না। টেপে আমার কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলেন ডজ, সেই লোকটার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমার কণ্ঠের মিল আছে। যে যে শব্দ দরকার সেগুলোই ক্রসওয়ার্ড পাজলের মাধ্যমে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। টেপে আমি জবাব দিয়ে পাঠিয়েছি। শুধু সেই শব্দগুলো বাদে আর সব মুছে ফেলেছেন। সকালে তার ড্রয়ার খুলে টেপটা পেয়েছি। সেই শব্দ নিয়ে গিয়ে শুনিয়েছেন শারিকে। মনে হয় যান্ত্রিক শব্দ চিনতে পারেনি ওটা। কাজেই জ্যান্ত মানুষটারই প্রয়োজন হয়েছে। ডজের। তখন আমাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করেছেন। আমার গলা শোনার আগে পর্যন্ত শিওর হতে পারেননি, কাজ হবে কিনা। সেজন্যেই কাল নার্ভাস হয়েছিলেন। ব্যাপারটা জানার জন্যে আর তর সইছিল না তার। নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে গাধাটার কাছে। তারপর যখন জানলেন, নিশ্চয় খেয়াল করেছ কি পরিমাণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন।
নীরবে কিশোরের কথাগুলো ভেবে দেখল মুসা আর রবিন।
হুঁ, অবশেষে মাথা দোলাল রবিন। যুক্তি আছে তোমার কথায়…
হ্যাঁ, মুসাও একমত হলো। কিন্তু এতসব ঝামেলা করতে গেলে কেন? না হয় একটা গাধার বাচ্চা তোমার স্বর চিনে সাড়াই দিল। এর জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবেন ডজ?
মাথা নাড়ল কিশোর। এর জবাব আমারও জানা নেই। তবে একটা কথা বড় বেশি খচখচ করছে মনে।
কি? জানতে চাইল রবিন।
একটা ব্যাপার হতেই পারে, বুঝিয়ে বলল কিশোর। দুজন মানুষের কণ্ঠস্বরে মিল থাকা সম্ভব। ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে একটা টেপ পেয়েছিলাম, মুসা, মনে আছে? ওটাতে রেকর্ড করা কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমার গলা মিলে যায়।
আবার নোটের দিকে তাকাল কিশোর। বারোদের দৃষ্টিশক্তিও খুব তীক্ষ্ণ্ণ। মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু যে গলার স্বর শুনে মানুষকে চিনতে পারে, তাই নয়, চেহারা দেখেও পারে।
মাথা ঝকাল রবিন। হ্যাঁ, তার মানে… থেমে গেল সে।
অন্য দুজনও শুনতে পেল শব্দটা। দ্রুত সরে যাচ্ছে পদশব্দ, বনের গভীরে। উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। পিছু নিল নিঃশব্দে।
কিন্তু ওদের চেয়ে বনটা অনেক ভাল চেনে যে যাচ্ছে। একটু পরেই ওকে হারিয়ে ফেলল ওরা। আর শুনতে পেল না পায়ের শব্দ। কোন শব্দই নেই আর, পাখির ডাক ছাড়া।
ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে পুরো এলাকাটা খুঁজে দেখবে ঠিক করল ওরা।
সেই মতই কাজ করল। খুঁজতে খুঁজতে সবার আগে খোলা জায়গাটায় ফিরে এল কিশোর। তারপর এল মুসা। মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে জানাল, লোকটাকে পায়নি। বসে পড়ল ঘাসের ওপর।
আরও মিনিট দশেক পর রবিন ফিরল। পকেটে হাত ঢোকানো। মুখে হাসি। এমন একটা ভঙ্গি, যেন জেনে এসেছে কিছু।
দেখেছ নাকি কাউকে? জিজ্ঞেস করল মুসা
না, জবাব দিল রবিন। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বলল, তবে এই জিনিসটা পেয়েছি।
পকেট থেকে হাত বের করল সে। আঙুলে ধরা জিনিসটা দেখাল।
দেখল কিশোর আর মুসা। তিন ইঞ্চি লম্বা একটুকরো উল। মেকসিকান শালের। রঙ লাল।
৬
শারিকে নিয়ে ভাবনা হচ্ছে আমার, পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বললেন ডজ।
ডিম ভাজা মুখে পুরে দিয়ে মুসা বলল, কি হয়েছে? মন খারাপ? মুখ গোমড়া? আকাশের তারা দেখে খালি?
টেবিলের নিচ দিয়ে ওর পায়ে লাথি মারল কিশোর।
মুসার কথা যেন কানেই যায়নি ডজের। আবার নার্ভাস লাগছে তাঁকে। খাবার প্রায় খেলেনই না। মাঠে থাকলে বিপদে পড়ে যাবে বারোটা।
সকালে ওটাকে মাঠে দেখেছে মুসা। তার মনে হয়েছে আরামেই আছে জানোয়ারটা। তাজা চেহারা। ঘাস খাচ্ছিল। চোখ চকচকে, চামড়া উজ্জ্বল, মসৃণ। ছাউনির বাইরে ছিল, কিশোরকে দেখেই ছুটে এসেছে। গাধার তুলনায় জোরেই ছোটে।
সেসব বলল না কিশোর। বলা যায় না, চুপ করে থাকলে রহস্যের আরেকটা সূত্র ধরিয়ে দিতে পারেন ডজ। নিরীহ ভঙ্গিতে বলল, শারি কি খাচ্ছে না?
ওর খুর নিয়ে ভাবনা হচ্ছে আমার। কফির কাপে চুমুক দেয়ার আগে ভ্রূকুটি করলেন ডজ। জানো হয়তো, বারোদের আদি নিবাস ছিল উত্তর আফ্রিকায়। যা শক্ত, পাথুরে মাটিতে হেঁটে আস্ত মানুষের নখের মতই ওদের খুরও দ্রুত বাড়ে। শক্ত মাটিতে ঘষা লেগে ক্ষয়ে গিয়ে স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু এখানকার মত নরম মাটিতে থাকলে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলেও অবাক হব না। কাপটা নামিয়ে রাখলেন তিনি। আর এ হারে বাড়তে থাকলে খোঁড়া হতে সময় লাগবে না।