লম্বা কানদুটোকে পেছন দিকে শুইয়ে ফেলল শারি। প্রায় ঘাড় ছুঁয়েছে কানের ডগা। ঘোড়ার স্বভাব জানা আছে মুসার। তা থেকেই আন্দাজ করল, সতর্ক হয়ে উঠেছে গাধাটা কিংবা রেগে গেছে। আরেকবার ডাকল নাম ধরে। কাছে তো এলই না, আরেকটু সরে গেল ওটা, দড়ি লম্বা হলে আরও সরত।
তুমি ডাকো, রবিনকে বললেন ডজ।
কি হবে ডেকে? এসব ছেলেমানুষী ভাল লাগছে না রবিনের। বললে আরও সরে যেতে চাইবে।
তা ঠিক। হাসলেন ডজ। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ডাকবে?
শারির আসা-যাওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই কিশোরের। এলেই বা কি, না এলেই কি? কিন্তু যে ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ডজ, কৌতূহল হল তার।
বিরক্তি চেপে জোরে ডাক দিল কিশোর, এদিকে আয়, শারি।
অদ্ভুত কান্ড করল শারি। ঝটকা দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এদিকে। সরাসরি কিশোরের দিকে। একবার কেঁপে উঠল কানের ডগা। সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল।
খাইছে! কান্ডটা কি হলো?
আবার! ফিসফিসিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন ডজ। আবার ডাকো!
আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর। আবার ডাক দিল, এদিকে আয়, শারি!
দড়ি বাঁধা পা দিয়ে বাতাসে লাথি মারল শারি, দড়িটা খুলে ফেলার চেষ্টা করল। তারপর দৌড়ে এল কিশোরের দিকে। ফুটখানেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল। গলা লম্বা করে নাক দিয়ে আলতো গুতো দিল ওর বুকে।
তোমার প্রেমে পড়ে গেছে! মেয়ে, গাধা তো! হেসে কিশোরের কাঁধে চাপড় মারল রবিন। কেমন লাগছে, কিশোর? মাত্র তিনটে শব্দ ব্যবহার করলে। আর জলজ্যান্ত একটা গাধাকে পটিয়ে ফেললে।
পিছিয়ে গেল কিশোর। গাধাটার এই আচরণ অবাক করেছে ওকে। রবিনের কথায় লজ্জা পেয়েছে।
আদর করো ওকে! কিশোরের হাত চেপে ধরল ডজ, যাতে সরে যেতে না পারে। দেখ, কি করে?
প্রচন্ড কৌতূহল চাপতে পারল না কিশোর। আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিল শারির মাথায়। ঝট করে কান সোজা করে ফেলল গাধাটা। আবার কিশোরের বুকে নাক ঘষল।
চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়েছে ডজের মুখে। যেন এইমাত্র বিরাট অঙ্কের একটা বাজি জিতে গেছেন, এমনি ভাবভঙ্গি। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরকে অবাক করে দিয়ে বললেন, নাহ, আর কোন সন্দেহ নেই আমার! আমি এখন শিওর, ও তোমাকে পিঠে চড়তে দেবে। যাও। ওঠো। বয়েস কম হলে কি হবে, যা শক্তি আছে তোমার মত একজন মানুষকে সহজেই বইতে পারবে। সাধে কি আর বলে ভারবাহী গাধা। এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন তিনি, যেন মস্ত এক দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেয়েছেন।
দ্বিধা করছে কিশোর। গাধার পিঠে চড়ার আগ্রহ নেই। কিন্তু ডজের অতি আগ্রহ অসংখ্য প্রশ্নের ভিড় জমিয়েছে ওর মনে। কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয় রয়েছে এসবের পেছনে। গোয়েন্দা হিসেবে এখন তার উচিত সমস্ত সূত্র খতিয়ে দেখা।
ডান পা তুলে দিয়ে লাফিয়ে গাধার পিঠে চড়ে বসল সে। ঘাড় বাঁকা করে বড় বড় কোমল চোখ মেলে ওকে দেখার চেষ্টা করল শারি। টান টান হয়ে গেছে কান, খাড়া হয়ে আছে মাথার ওপর। সওয়ারি হিসেবে কিশোরকে নিতে মনে হয় আপত্তি নেই তার।
হ্যাঁ, এবার চলতে বলো। ফিসফিস করে শিখিয়ে দিলেন ডজ। গলায় উত্তেজনা।
হঠাৎই কথাটা মনে পড়ে গেল কিশোরের। প্রকাশ করল না সেটা। চলতে বলল গাধাটাকে।
টলমল পায়ে আগে বাড়ল ওটা। জিন, লাগাম কিছুই নেই। শারির গলা জড়িয়ে ধরে রাখতে হলো কিশোরকে, যাতে পড়ে না যায়। একটা সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন তাকে ডজ। মেকসিকোতে তো বটেই, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলেও কাউবয়রা ঘোড়া চালানোর সময় কিছু বিকৃত শব্দ ব্যবহার করে, যেমন, চলতে বললে বলে গিডিআপ, আর থামতে বললে হুয়া। সেটাই পরখ করে দেখার ইচ্ছে হলো তার। কয়েক কদম এগোতেই বলল সে, হয়া, শারি, হয়া!
সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করল গাধাটা। থেমে গেল।
বাহ! এগিয়ে এলেন ডজ। কিশোরকে গাধার পিঠ থেকে নামতে সাহায্য করলেন। চমৎকার শিখে ফেলেছ তো তুমি। গাধাটাকেও পোষ মানিয়ে ফেলেছ।
হ্যাঁ, মুসা বলল। মানুষ, জানোয়ার সব কিছুকেই পোষ মানাতে ওস্তাদ কিশোর পাশা। ও যে কোন কাজটা পারে না, সেটাই বুঝি না মাঝে মাঝে।
মজার কান্ড করল, ডজের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। ভুল করে হয়তো আমাকে অন্য কেউ ভেবেছে শারি, যার কথা সে শোনে।
তা কি করে হয়? মাথা নাড়লেন ডজ। এখানে যখন এসে ঢুকল, পুরোপুরি বুনো ছিল শারি। সারা জীবনে কেবল দুজন লোককে দেখেছে। আমাকে, আর পিরেটোকে।
কিন্তু আপনাদের দুজনের কারও মতই দেখতে নই আমি। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল গোয়েন্দাপ্রধান। জটিল কোন ভাবনা মাথায় ঢুকলেই মাঝে মাঝে এই কাজটি করে সে। তার ধারণা এতে তার ভাবনার একাগ্রতা আসে।
আধঘণ্টা পরে যখন বিশাল ঘরটায় এসে বসল, তখনও চিমটি কাটা বন্ধ হলো না তার। রবিন আর মুসাও বসেছে ওর সঙ্গে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল সে, মাঠের ধারের ছাউনিটার দিকে। বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সাদা গাধাটা। এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে জানোয়ারটাও। আস্তে করে ডাক দিচ্ছে, যেন চাইছে কিশোর গিয়ে আবার তাকে আদর করুক।
শারি! ছিপটা জোড়া লাগাতে লাগাতে আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা। ঠিক, মনে পড়েছে। শারি হলো গিয়ে ড্যাগউডের স্ত্রীর নাম! যে ধাঁধাটার সমাধান করেছিলে সেদিন, তাতে একটা জবাব ছিল, শারি।