চত্বর থেকে বেরিয়েই পেছনে তাকাল কিশোর। আছে। একটা সাইডওয়াকের ওপর দাঁড়িয়ে জীপটার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে লাল শাল পরা মহিলা। ওর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল কিশোর। তবে মহিলা তার জবাব দিল না।
তাতে কিছু মনে করল না কিশোর। এটাই বরং স্বাভাবিক। কয়েক হাজার পেসো খরচ করেছে মহিলা, সেই মেকসিকান লোকটাকে দিয়েছে ওদেরকে ঠেকানোর জন্যে। পুরো টাকাটাই জলে গেছে। ঠিকই লারেটোতে পৌঁছেছে তিন গোয়েন্দা।
৪
র্যাঞ্চে পৌঁছতে দুই ঘণ্টা লাগল।
এঁকেবেঁকে, কখনও ঘুরে ঘুরে চলে গেছে পাহাড়ী পথ। পাহাড়ের ঢাল বনে ছাওয়া। সামনে, দূরে একসারি উঁচু পর্বত। ডজ জানালেন, ওটাই সিয়েরা মাদ্রে।
টেলিভিশনে দেখা পুরানো একটা সিনেমার কথা মনে পড়ল রবিনের। হেসে জিজ্ঞেস করল সে, ওই সিয়েরা মাদ্রে পর্বতেই হামফ্রে বোগার্ট আর তার সাথীরা গুপ্তধন খুঁজতে গিয়েছিল, তাই না?
রবিনের কথায় কেন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন ডজ। মাথা নেড়ে বললেন, দ্য ট্রেজার অভ সিয়েরা মাদ্রে শুধুই একটা ছবি। সত্যি নয়। ওই পর্বতে গুপ্তধন নেই।
চট করে পেছনের সীটে বসা মুসার দিকে তাকাল রবিন।
এর খানিক পরেই র্যাঞ্চে পৌঁছল ওরা। কাঠের তৈরি লম্বা, নিচু একটা বাড়ি। চারপাশের খোলা প্রান্তর ঢালু হয়ে নেমে গেছে একটা লেকের ধারে। মাঠে কয়েকটা ঘোড়া চরছে, এছাড়া জীবনের আর কোন চিহ্নই নেই কোথাও।
লেকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। দুই-তিন মাইল লম্বা আর আধমাইল মত চওড়া হবে লেকটা, আন্দাজ করল সে। ভাবল, মাছ ধরার চমৎকার জায়গা। সাথে করে ছিপ নিয়ে আসায় ভালই হয়েছে। লেকের অন্যপাশে আর কোন বাড়ি-ঘর নেই। কেবল গাছের জটলা। তবে গাছপালার ওপাশে পুরানো একটা বাড়ির টাওয়ার চোখে পড়ছে। গির্জা হতে পারে, কিংবা দুর্গ। হয়তো মানুষ বাস করে ওখানে।
ডজের পিছু পিছু বারান্দায় উঠল ওরা। বড় একটা ঘরে ঢুকল। ফায়ারপ্লেস আছে। আরাম করে বসার জন্যে আছে অনেকগুলো চেয়ার।
খিদে পেয়েছে নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করলেন ডজ।
একেবারে মনের কথাটা বলে ফেলেছেন, মুসা বলল।
হাত তালি দিল ডজ। সঙ্গে সঙ্গে এসে ঢুকল একজন মেকসিকান লোক।
ওর নাম পিরেটো, ডজ জানালেন। আমার বাবুর্চি। তিন গোয়েন্দার নাম ধরে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজনই বোধ করলেন না যেন।
পিরেটোর বয়স পঞ্চাশের মত। গাট্টাগোট্টা শরীর। বাদামী মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ, লম্বা কালো চুল। গায়ে ডেনিম শার্ট, পরনে জিনস, পায়ে কাউবয় বুট। বাবুর্চি না হয়ে র্যাঞ্চ হ্যান্ড বা রাখাল হলেই যেন বেশি মানাত তাকে, ভাবল কিশোর।
দ্রুত স্প্যানিশ ভাষায় লোকটাকে নির্দেশ দিতে লাগলেন ডজ। নাস্তা আর এক্ষুণি শব্দ দুটো বুঝতে পারল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল পিরেটো। চোখের মণি বাদামী, তবে এতটাই গাঢ়, প্রায় কালোই মনে হয়। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল রবিন, কথা বলার সময় ডজের দিকে সরাসরি তাকায় না। কেমন যেন একটা এড়িয়ে চলার প্রবণতা। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রক গায়কের মাঝে যেমন থাকে অনেকটা তেমনি।
ভাল বাবুর্চি পিরেটো। মুসা আর কিশোর শুয়োরের মাংস খায় না, জেনে গেছে। তাই গরুর মাংস ভাজা করে আনল। সেই সঙ্গে প্রচুর ডিম আর গরম গরম রোল।
লম্বা টেবিলটার মাথায় তিন গোয়েন্দার সঙ্গে বসলেন ডজ, তবে খেলেন না কিছু। কাঁটা চামচ দিয়ে একটা রোলকে খোঁচাতে থাকলেন নার্ভাস ভঙ্গিতে। তিন গোয়েন্দার খাওয়া শেষের অপেক্ষা করছেন, যেন কিছু বলার জন্যেই। কিছু একটা ভাবিয়ে তুলেছে মনে হয় তাকে।
পেট ভরল? মুসাকে শেষ টুকরোটা মুখে পুরতে দেখে বললেন তিনি।
বোঝাই হয়ে গেছে। দারুণ লাগল।
উঠে দাঁড়ালেন ডজ। এসো তোমাদেরকে র্যাঞ্চটা দেখাব।
বাইরে বেরিয়ে দ্রুত একটা বেড়ার কাছে নিয়ে এলেন ওদেরকে। অনেকখানি জায়গা ঘিরে বেড়া দেয়া হয়েছে। মাঠের এক ধারে ছোট একটা কাঠের ছাউনি।
এসো, আমার বারো দেখাব। ওদের মতামতের অপেক্ষা না করেই ছাউনিটার দিকে এগিয়ে গেলেন ডজ। ওটার কাছে পৌঁছার আগেই ছাউনি থেকে বেরিয়ে এল একটা গাধা, মেকসিকানরা বলে বারো। বেরিয়েই ওদেরকে দেখে থমকে গেল, তারপর যেন লজ্জা পেয়েই ওদের কাছ থেকে সরে গেল।
মেরুদন্ডের ওপর দিয়ে কালো একটা দাগ গিয়ে কাঁধের কাছটায় ছড়িয়ে পড়েছে জানোয়ারটার। চামড়াটাকে প্রায় সাদাই বলা চলে। বড় বড় কান, লম্বা লেজের মাথায় চুলের ঘন গোছা। সামনের একপায়ে দড়ি বাঁধা। সেটা ছুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করল।
যে-কোন পোষা জানোয়ার মুসার পছন্দ। গাধাটাকে আদর করার জন্যে এগোতে গেল সে। থামিয়ে দিলেন ডজ। ছুঁয়ো না। বয়স একেবারেই কম, বড়জোর দুবছর। পোষ মানেনি এখনও।
কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে মাটিতে পা ঠুকছে গাধাটা। এলোপাতাড়ি কয়েকবার পেছনের পা ছুঁড়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল কাছে গেলে ভাল হবে না।
অনেক বুনো গাধা আছে এখানকার পাহাড়ে, ডজ জানালেন। মাস দুই আগে আমার মাঠে ঢুকে পড়েছিল ওটা। ধরে ফেললাম। ওর নাম রেখেছি শারি। মুসার দিকে তাকালেন তিনি। নাম ধরে ডেকে দেখ। বলো, এদিকে এসো, শারি। দেখ কি করে।
ব্যাপারটা কি? ওদেরকে শিশু মনে করছেন নাকি ডজ? এমন ভাবে কথা বলছেন! তবে যেহেতু জানোয়ারটাকে ভাল লেগেছে তার, ডজের কথামত ডাক দিয়ে বলল, এখানে এসো, শারি। এসো।