আরও অনেক কিছু। বলবে কিনা দ্বিধা করছে রবিন। এই যেমন, মরুভূমি। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে বাস। লোকজন নামছে। তারপর যেন নির্জন অঞ্চলে হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। একেবারে নো ম্যানস ল্যান্ডের মাঝে। অবাক লাগে। এই মরুভূমির মাঝে কোথায় যায়?
যার যার খামারে। কাউকে কাউকে পাঁচ মাইল কিংবা তারও বেশি হাঁটতে হয় বাস থেকে নামার পর।
এতো! অথচ দেখে মনে হয় যেন এই মিনিট পাঁচেকের পথ হাঁটতে যাচ্ছে। হাসিমুখে নামছে বাস থেকে। দিব্যি চলে যাচ্ছে, যেন কিছুই না।
আসলে তা নয়। মরুভূমির ভেতরে হাঁটাটা সত্যিই কঠিন। তবে আমেরিকানদের মত মুখ গোমড়া করে রাখে না মেকসিকানরা। হাসিখুশি থাকতেই পছন্দ করে।
ছোট একটা শহরে ঢুকে একটা দোল দিয়ে থেমে গেল বাস। ম্যাপ দেখল কিশোর। তারপর ফিরে তাকিয়ে মুসা আর রবিনকে ইশারা করল। আবার বাস বদলাতে হবে।
মেকসিকান মেয়েটাকে গুড বাই জানিয়ে র্যাক থেকে ব্যাগ নামাল রবিন।
ব্যস্ত রাস্তার ছোট একটা কাফের সামনে বাস স্টেশন। বেরিয়েই কাফেটাতে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
আমার যা খিদে পেয়েছে না! একটা টেবিলে বসতে বসতে মুসা বলল।
সে আর রবিন খাবারের তালিকা ভাল করে দেখেশুনে অর্ডার দিল বীফ বুরিটুস উইথ রাইস অ্যান্ড বীন। এই খাবারগুলো তেমন ভাল লাগে না কিশোরের। সে অর্ডার দিল দুটো চিকেন টাকোর। কিন্তু খাওয়ার পর বুঝতে পারল ভুলটা কি করেছে।
বাপরে বাপ! কাফে থেকে বেরোনোর সময় বলল কিশোর, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে জিভে। এত্তো ঝাল! মরিচ গুলে দিয়েছে!
বাসের দিকে এগোচ্ছে, হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল চামড়ার ছেড়া জ্যাকেট পরা এক লোক। লম্বা, ভারি শরীর, বয়েস বিশ হবে। কিশোরের বুকে ধাক্কা দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে স্প্যানিশে বলল, যাচ্ছ কোথায়? বাসে জায়গা নেই।
অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। লোকটাকে আগেই দেখেছে। তখন তো বেশ আন্তরিক মনে হয়েছিল। এখন এরকম আচরণ করছে। কেন?
কিশোর দেখতে পাচ্ছে, বাসের অর্ধেক সীটই খালি। ভদ্র ভাবে সেকথা বলল লোকটাকে।
একটুও নরম হলো না লোকটা। বরং আরও জোরে ধাক্কা লাগাল, না, হবে না। বাসে উঠতে পারবে না। চলে যাও এখান থেকে। আমেরিকায় ফিরে যাও, তিনজনেই। তোমাদেরকে এখানে চাই না আমরা।
কিন্তু আমরা যাচ্ছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি ওই বাসে উঠবই। দয়া করে সামনে থেকে সরুন।
সরা তো দূরের কথা, কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল লোকটা। ভাল চাইলে, কেটে পড়। নইলে বিপদ হবে বলে দিলাম।
কয়েক হপ্তা ধরে জুডোর প্র্যাকটিস বেশ জোরেশোরে চালিয়েছে কিশোর। অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তবু মনে হলো, বিশালদেহী এই মেকসিকানটার সঙ্গে জুডো খাটিয়েও পেরে উঠবে না। সে কিছু করার আগেই এক ঘুসিতে তার দাঁত ভেঙে দেবে লোকটা। এক ঝাড়া দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে এল কিশোর, লোকটা ঘুসি মারলেও যাতে তার মুখে লাগাতে না পারে।
চুপ করে সব দেখছিল এতক্ষণ মুসা। চট করে এখন পাশে চলে এল কিশোরের। কি, হচ্ছেটা কি? লোকটা যে ওদেরকে বাসে উঠতে দিতে চায় না একথা মুসাকে বলল কিশোর।
কেন?
কি জানি। হয়তো আমেরিকানদের পছন্দ করে না।
ও, তাই। কিন্তু আমরা যে সব বলে ঠিক করেছি। বলে দাও ওকে।
ঘুসি মেরে বসল লোকটা। লাগলে চিত হয়ে যেত মুসা। কিন্তু চোখের পলকে সরে গেল সে। পরক্ষণেই আঘাত হানল, কাঁধের সামান্য নিচে, কারাতের শুটোউচি। আরেকটা ঘুসি মারার জন্যে তৈরি হচ্ছিল লোকটা, তার আগেই অবশ হয়ে গেল তার কাঁধের কাছটা। প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া মানুষের মত ঝুলে পড়ল তার হাত চেপে ধরল আহত স্থান। মুসার মুখের দিকে তাকাল।
অপেক্ষা করছে মুসা। সামান্য বাঁকা করে রেখেছে পা। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে, হাতের আঙুল একদম সোজা।
অবাক হয়ে গেছে মেকসিকান লোকটা। আহত জায়গায় হাত চেপেই রেখেছে। তারপর কয়েক ডলা দিয়ে যেন সেখানে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাল।
ডান হাতটা উঁচু করল মুসা। লোকটা আগে বাড়লেই কারাতের কোপ মারবে।
মাথা নাড়ল লোকটা। বিড়বিড় করে বলল, অনেক হয়েছে। ঘাড় মটকে আর মারা পড়তে চাই না! বাপরে বাপ! দশ লাখ পেসো দিলেও না!
মাথা নাড়তে নাড়তেই সরে পড়ল সে।
হেঁচকি উঠল কিশোরের। হেসে ফেলল রবিন আর মুসা। লাল হয়ে গেল কিশোরের গাল।
কী? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, চিকেন টাকো পেটেও আগুন লাগিয়েছে? খাও আরও।
এই চলো, তাগাদা দিল মুসা। আমাদের বাস রেডি।
বাসে উঠল তিন গোয়েন্দা। কাফেতে সেই লাল শাল পরা মহিলাকে দেখা যায়নি। বাসে উঠে দেখা গেল পেছনের সীটে বসে আছে।
পার্স থেকে কয়েকটা নোট বের করে জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দিল। বাদামী একটা হাত দেখতে পেল তিন গোয়েন্দা। পলকের জন্যে চোখে পড়ল পুরানো চামড়ার জ্যাকেটের হাতা।
ওরা সীটে বসতে না বসতেই চলতে শুরু করল বাস।
দীর্ঘ যাত্রার এটাই শেষ পর্যায়। একসময় ঢুলতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। অস্বস্তিকর তন্দ্রা। সারাটা রাতই কাটল প্রায় এই অবস্থায়। জায়গায় জায়গায় পথ ভীষণ খারাপ। ঘুমানো অসম্ভব।
সকাল নটার দিকে লারেটোতে পৌঁছল বাস। গাছে ঘেরা একটা ছোট চত্বরে একসারি বেঞ্চ রাখা, ওটাই বাস স্টেশন।
সীমান্ত পার হয়েই ডজকে ফোন করেছিল কিশোর। বাস থেকে নেমে দেখল, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জীপ নিয়ে। ওদেরকে দেখে খুশি হয়েছেন, তবে বেশ অস্থির। অবাকই লাগল তিন গোয়েন্দার। ওরা গাড়িতে ব্যাগ তোলার সময় বারবার বলতে লাগলেন, র্যাঞ্চে পৌঁছতে দেরি হবে না। কিশোরের মনে হলো, ওদেরকে নয়, নিজেকেই বোঝাচ্ছেন যেন।