পর্বতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। ছুটে আসা লাভার উত্তাপ এসে লাগছে চোখে, জ্বালা করছে। কিন্তু তার পরেও চোখ বন্ধ করল না, জোর করে পাতা মেলে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
কাচ ভাঙার শব্দ বাড়ছে। সেই সাথে মারাত্মক ওই আগুনের নদীর ওপর কালো এক ধরনের আস্তর পড়ছে। জমে যাচ্ছে লাভা। ঢাল বেয়ে গড়ানো কমছে। আশা ঝিলিক দিয়ে গেল রবিনের মনে। গড়িয়ে গড়িয়ে যেন অনেক কষ্টে এগোল আরও কয়েক গজ, আগের সে জোর নেই, তারপর থেমে গেল একেবারেই।
ছাই আর গরম পুঁতি-বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে আসছে। দেখতে দেখতে সেসব পেছনে ফেলে এল ভীত ঘোড়া আর বারোগুলো।
অবশেষে বিপদসীমা ছাড়িয়ে আসতে পারল ওরা।
আরও আধ মাইল পর পৌঁছল উপত্যকায়। পিরেটো ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল পরের পর্বতটার দিকে। কিছুদূর গিয়ে থামল।
বিষাক্ত ধোঁয়া আর গ্যাসের মধ্যে শ্বাস নিয়েছে, এতক্ষণে তার জের শুরু হলো। কাশতে আরম্ভ করল সবাই। নাক উঁচু করে বড় বড় দম নিয়ে টেনে নিতে লাগল তাজা বাতাস। ফিরে তাকাল আগ্নেয়গিরির দিকে।
পিরেটো দেখতে পেল তাকে প্রথমে। হাত তুলে দেখাল অন্যদেরকে। বহু দূরে একটা মূর্তি লাফিয়ে চলেছে পাথর থেকে পাথরে। পড়ে যাচ্ছে, হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠছে আবার, সরে আসার চেষ্টা করছে ভিলার গুহার কাছ থেকে।
পর্বতের ওদিকটায় লাভার স্রোত সবে চূড়ার একটা নিচে নেমেছে, তরল রয়েছে এখনও, নেমে আসতে শুরু করল দ্রুত। সামনে এখন জীবন্ত যা কিছু পড়বে, ধ্বংস করে দেবে ওই মৃত্যু নদী!
পর্বতের ভেতরে শব্দ অদ্ভুত সব কান্ড করে। আগ্নেয়গিরির গর্জনকে ছাপিয়েও কি ভাবে জানি শোনা গেল ডজের আতঙ্কিত চিৎকার। একবারই, তারপর হারিয়ে গেল গলিত লাভার নিচে। ঢেকে দিয়ে ছুটে নামতে থাকল মারাত্মক ওই তরল পদার্থ।
চোখ বন্ধ করে ফেলল চার কিশোর। কিশোর ভাবছে, বাজে লোক ছিল ডজ মরিস, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার খাবার খেয়েছে ওরা, তার বাড়িতে থেকেছে, এক সঙ্গে অভিযানে বেরিয়েছে। ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সাধারণ ভাবে মরলে এতটা খারাপ লাগত না। কিন্তু এরকম ভয়াবহ মৃত্যু! মনই খারাপ হয়ে গেল।
নিজের বুকে ক্রুশ আঁকল পিরেটো। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করল স্প্যানিশ ভাষায়।
তোমাকে বলেছিলাম না, কিশোরকে বলল সে। বিপদ আছে পাহাড়ে। দেখলে তো।
পাহাড়ের পাদদেশের পথ ধরে এগোল আবার ওরা। পিরেটোর পাশে পাশে চলছে ইসাবেল। পিরেটো, কিছু মনে কোরো না। জানি, তোমার লোভ নেই, কিন্তু পেসেগুলো পেলে অনেক সুবিধে হত। র্যাঞ্চটা আবার কিনে নিতে পারতে।
কে জানে? পিরেটো বলল আনমনে, আপনাআপনিই হয়তো আমার র্যাঞ্চ আমার কাছে ফিরে আসতে পারে আবার।
হাসল সে। লোভের ছিটেফোঁটাও নেই সে হাসিতে।
ভিলার গুহাঁটার কথা প্রথম শুনি মায়ের কাছে, জানাল মেকসিকান। মা আমাকে বলেছিল, অভিশপ্ত ওই পেসো কেউ কোনদিন পাবে না। ভিলার বহু লোক মারা গেছে এর জন্যে। এখনও মরা সৈন্যদের প্রেতাত্মা পাহারা দিচ্ছে ওগুলোকে। একটা মুহূর্ত থামল সে। তারপর বলল, পাহারা দিয়ে যাবে আজীবন।
১৭
বিপদ সীমার বাইরে থেকে, আগ্নেয়গিরিকে বহুদূর দিয়ে ঘুরে চলতে লাগল দলটা। পর্বতের ওপাশের গাঁয়ে যাবে, যেখানে আগ্নেয়গিরির উৎপাত পৌঁছতে পারে না। তাছাড়া ঘনঘন অগ্ন্যুৎপাত হয় বলে কাছাকাছি থাকেনি লোকে, এমন জায়গায় রয়েছে যেখানে লাভা পৌঁছতে পারে না কোনমতেই। এমনকি গরম ছাইও না।
কথাবার্তা তেমন বলছে না ওরা। কিশোরের মন এখন শান্ত। রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।
পিরেটোর কাছে ভিলার গুপ্তধনের কথা প্রথম শুনেছে ইসাবেল। ১৯১৬ সালে, ওর দাদা ছিল পঞ্চো ভিলার সেনাবাহিনীতে। ইসাবেল পিরেটোকে কথা দিয়েছিল, তার স্বামী আর ছেলে যদি পেসোগুলো খুঁজে পায় তাহলে অর্ধেক দিয়ে দেবে ওকে।
ডজ জানত না গুপ্তধনের কথা। তার কাছ থেকে এটা গোপন রাখা হয়। পিরেটো ঘুণাক্ষরেও কখনও তার সামনে উচ্চারণ করেনি। এই সময় টনি এসে একদিন হাজির হলো অন্ধ বারোটাকে নিয়ে। পিরেটোর সঙ্গে পেসোগুলোর কথা আলোচনা করার সময় শুনে ফেলে ডজ। জেনে যায় টনি আর তার বাবা গুহাঁটা আবিষ্কার করে ফেলেছে।
টনিকে রাজি করাতে না পেরে শেষে শারিকে দিয়ে গুহাঁটা খুঁজে বের করার ফন্দি আঁটে ডজ।
র্যাঞ্চারের বীভৎস মৃত্যুর ধাক্কাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিশোর। ডজের লোভই তাকে ওরকম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে এটা দেখার পরেও যদি পেসো আনতে না যেত তাহলে আর এভাবে মরতে হত না।
একটা গর্তের ধারে থামল ওরা, জানোয়ারগুলোকে পানি খাওয়ানোর জন্যে। তারপর আবার এগোনোর পালা। কয়েক মাইল এগিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ কানে এল কিশোরের। দূর থেকে আসা অসংখ্য বারোর মিলিত ডাক। সাড়া দিল শারি। বাড়িয়ে দিল চলার গতি।
একটা বন থেকে বেরোতেই জোরাল শোনা গেল আওয়াজ।
বিশাল উপত্যকায় ছড়িয়ে রয়েছে মাইলের পর মাইল তৃণভূমি। শত শত বুনো বারো চরে বেড়াচ্ছে সেখানে। লাফালাফি করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে।
দাঁড়িয়ে গেছে শারি। খাড়া হয়ে গেছে লম্বা কান, ডগা কাপছে মৃদু মৃদু। হঠাৎ জোরে তীক্ষ্ণ এক ডাক ছাড়ল সে। ওর পিঠ থেকে নেমে পড়ল কিশোর। জিন আর লাগাম খুলে নিল। তারপর আদর করে চাপড় দিল গলায়।
বড় বড় কোমল চোখ মেলে তার দিকে তাকাল শারি। নাক ঘষল গায়ে, যেন বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। তারপর এগিয়ে গেল টনির কাছে। ঘোড়ার পিঠে থাকায় ওর বুক নাগাল পেল না বারোটা, পায়েই নাক ঘষল। নিচু হয়ে শারির মাথা চাপড়ে দিল টনি।