শারিকে আরও জোরে চলার তাগাদা দিল কিশোর। পেছনে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়াগুলোও চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মিনিট খানেক পরেই দেয়ালের মত ঢালটার কাছে চলে এল ওরা। থামল।
জিনের নিচে ভাঁজ করে রাখা কম্বলটা বের করল পিরেটো। ছুরি দিয়ে কেটে ফালা ফালা করতে লাগল।
ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছে কিশোর। তাকে ডেকে বলল পিরেটো, তাড়াতাড়ি আসবে।
সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। গুহায় এসে দেখল, পিঠে পিঠ লাগিয়ে বাঁকা হয়ে আছে মুসা আর রবিন। মুসা সবে রবিনের বাঁধনের একটা গিঁট খুলেছে।
ডজের ছুরি দিয়ে দ্রুত ওদের বাঁধন কেটে মুক্ত করল কিশোর।
আমি তো ভেবেছি পিজা কিনতে দেরি করছ। হাত-পা ছড়িয়ে, ঝাড়া দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিতে লাগল মুসা। তারপর? কোথায় দোকানটা?
রবিনও মুসার মতই হাত-পা ঝাড়ছে। তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের মাথার দিকে। ব্যাপার কি? মাথায় পুঁতি পরার শখ হলো কেন হঠাৎ?
চুলে আঙুল চালিয়ে ওগুলো ফেলার চেষ্টা করল কিশোর। ঠান্ডা হয়ে গেছে পুঁতির মত জিনিসগুলো, কিন্তু আটকে গেছে এমন করে, আঙুল দিয়ে চিরুনি চালিয়ে কিছুতেই সরাতে পারল না। আকাশ থেকে পড়ল। গরম কাচের টুকরো। এসো, বেরোও, জলদি।
সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে মাথা নিচু করে প্রায় দৌড়ে বেরোল ওরা। কাচ-বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে আপাতত। কম্বলের লম্বা কয়েকটা টুকরো ওদেরকে দিয়ে বলল পিরেটো, নাও, মাথায় জড়াও। হাতেও পেঁচিয়ে নাও। খোলা রাখবে না। ওর নিজের মাথায় আর হাতে ইতিমধ্যেই জড়ানো হয়ে গেছে।
লাল শালটা দিয়ে মাথা আর কাঁধ ঢেকেছে ইসাবেল।
চলো, এবার যাই, তাগাদা দিল পিরেটো।
কাউকে বলতে হলো না। মুসা চড়ে বসল টনির পেছনে। রবিন পিরেটোর।
এই বার আগে আগে চলল মেকসিকান। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে জোরে চলা বিপজ্জনক, কিন্তু পরোয়া করল না সে, বার বার তাগাদা দিতে লাগল ঘোড়াকে। নেমে চলল নিচের উপত্যকার দিকে। যে নালাটা পাহাড়ের ঢালে গভীর খাত সৃষ্টি করে নেমেছে, সেটাতে নেমে আরও তাড়াতাড়ি চলার নির্দেশ দিল পিরেটো। পেছনে ভারি একটা গুড়গুড় শোনা গেল, মেঘ ডাকার মত। বাতাসে গন্ধকের গন্ধ বেড়ে গেছে, শ্বাস নেয়াই কঠিন।
নালায় নামার খানিক পরেই ঘটল ঘটনাটা। আধ মাইল দূরেও নেই আর গুহাঁটা, এই সময় পেছনে ফেটে পড়ল যেন আগ্নেয়গিরি। মুসার মনে হলো, বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে গেছে গোটা পর্বত।
চূড়া থেকে খাড়া উঠে গেল গরম গলিত লাভা, ফোয়ারার মত ঝরে পড়তে লাগল। আরও লাভা ছিটকে উঠল ওপরে। পড়ল, উঠল। প্রতিবারেই আরও বেশি ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওপরে উঠে এমন করে ছড়াচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। অসংখ্য বোমা ফাটার মত শব্দ হচ্ছে জ্বালামুখের ভেতরে। কানে তালা লাগানোর জোগাড়। শুধু যে লাভা বেরোচ্ছে তা নয়, সাথে করে পর্বতের গভীর থেকে নিয়ে আসছে পাথর। ঢাল বেয়ে গড়াচ্ছে সেগুলো ৷ গনগনে কয়লার মত গরম। নামতে শুরু করেছে লাভার স্রোত।
ক্রমেই জোর বাড়ছে লাভার। শত শত ফুট ওপরে উঠে যাচ্ছে এখন। ব্যাঙের ছাতার মত ছড়িয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে পাথরের ওপর। ঢাল বেয়ে নামছে। চলার পথে ঢেকে দিয়ে আসছে পাথর, গাছপালা সব কিছু। বাষ্প উঠছে। এদিক-ওদিক থেকে এসে মিলিত হচ্ছে লাভার একাধিক স্রোত। যতই নামছে চওড়া হচ্ছে আরও গলিত লাভার নদী হয়ে নামছে নিচের দিকে।
গরম ছাই, পাথরের কুচি আর কাচের টুকরোর বৃষ্টি পড়তে লাগল যেন অভিযাত্রীদের ওপর। চমকে চমকে উঠছে ভীত জানোয়ারগুলো। গরম পাথর আর কাচের ছ্যাঁকা লাগছে ওগুলোর তোলা চামড়ায়। আর সইতে না পেরে পিরেটোর ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ পেছনের দুই পায়ে ভর করে। পরক্ষণেই মাটিতে নেমে লাথি মেরে যেন তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল অবাঞ্ছিত বিপদকে। পিরেটোও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ঘোড়াটাকে। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে রবিন।
শারিকে নিয়ে এসো! চেঁচিয়ে উঠল পিরেটো।
বারোটাকে নিয়ে দ্রুত এগোল কিশোর।
ঘোড়াগুলোর মাঝে ঢুকিয়ে দাও ওকে! পিরেটো বলল। শান্ত করুক!
লম্বা দম নিল কিশোর। তারপর প্রায় চোখমুখ বুজে বারোটাকে নিয়ে এগোল আতঙ্কিত দুটো ঘোড়ার মাঝের সরু ফাঁকে ঢোকানোর জন্যে।
ওদের মাঝে একটা শান্ত জানোয়ারকে দেখে ধীরে ধীরে ঘোড়াগুলোও শান্ত হয়ে এল। দুলকি চালে চলছে শারি। ঘোড়াগুলোও একই রকম করে চলতে লাগল।
পাথর-বৃষ্টি পাতলা হয়ে এল জোরাল বাতাসে। নাকে এসে ঝাপটা মারল বাতাস। গন্ধকের গন্ধে দম আটকে যাওয়ার অবস্থা হলো কিশোরের! তাড়াতাড়ি কম্বলের টুকরো দিয়ে নাকমুখ চাপা দিল। আশঙ্কা হতে লাগল তার, এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে তো?
পেছনে ফিরে তাকাল রবিন। এগিয়ে আসছে আগুন-গরম, লাল রঙের গলিত লাভা। পাথর গলিয়ে ফেলছে। আগে আগে ছুটছে প্রাণ ভয়ে ভীত ছোট ছোট জানোয়ারের দল, চিৎকার করে উড়ছে পাখিরা। জ্বলে উঠছে ঝোঁপঝাড়। শিল-নোড়া দিয়ে কাচ গুঁড়ো করার মত একটা শব্দ উঠছে কড়কড় কড়কড় করে। লাভার নদী বয়ে আসার সময়ই হচ্ছে শব্দটা।
গেছি, ভাবল সে। এভাবেই তাহলে মরণ লেখা ছিল কপালে! মুসাকে বলল, যাক, আর দশজনের মত সাধারণ মৃত্যু হচ্ছে না আমাদের।
ঠিক, জবাব দিল মুসা। আগ্নেয়গিরির লাভায় চাপা পড়ে মরার ভাগ্য কজনের হয়?