বলছি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর।
মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে কানা মোচড়াতে শুরু করলেন ডজ। পায়ের ওপর শরীরের ভার বদল করলেন। তাকিয়ে রয়েছেন জুতোর দিকে। তারপর মুখ তুলে হাসলেন। বেশ, যাবে ওরাও।
খটকা লাগল কিশোরের। এত সহজে রাজি হয়ে গেলেন ভদ্রলোক! যেন তৈরি হয়েই এসেছেন, কিশোরকে নিতে হলে তার দুই সহকারীকেও নিতে হবে। মুসার কথা মনে পড়লঃ অনেকটা জোর করেই তিনটে কপি গছিয়ে দিল আমার হাতে! ব্যাপার কি!
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার একটা ম্যাপ দিলেন ওদেরকে ডজ। তার র ্যাঞ্চের কাছাকাছি শহর লারেটোতে কি করে যেতে হবে বলে দিলেন। ছশো ডলার কিশোরের হাতে দিলেন, ওদের রাহা খরচের জন্যে। নিজের ফোন নম্বর দিলেন যাতে সীমান্ত পার হয়েই তাকে ফোন করে জানাতে পারে। ওদেরকে তখন লারেটো থেকে তুলে নিতে পারবেন।
গাড়িতে গিয়ে উঠলেন ডজ। মেকসিকোর নম্বর প্লেট লাগানো। গাড়িটা চেনা চেনা লাগল মুসার। আগেও যেন কয়েকবার দেখেছে। কোথায়? মনে পড়ে গেল। সুপারমার্কেটে একবার। আর একবার দেখেছে ইয়ার্ডের গেটে। সেকথা বলল কিশোরকে।
পরদিন সকালে অন্যান্য দিনের মতই ইয়ার্ডের ডাকবাক্স খুলল কিশোর। চিঠিপত্র কি এসেছে বের করতে গিয়ে দেখল একটা ম্যানিলা খামও রয়েছে। ভেতরে শক্ত চারকোণা একটা জিনিস। ঠিকানায় তার নাম লেখা। ডাক টিকেট নেই। তার মানে ডাকে আসেনি খামটা, কেউ এসে ঢুকিয়ে রেখে গেছে।
হেডকোয়ার্টারে এনে খামটা খুলল সে। একটা ক্যাসেট। আর কিছু নেই। লেবেলে এমন কিছুই লেখা নেই যা দিয়ে বোঝা যায় কি রেকর্ড করা রয়েছে টেপে।
একটা টেপ রেকর্ডারে ভরে বোতাম টিপল সে। নীরবে ঘুরতে লাগল টেপ। অনেক পরে কথা বলে উঠল একটা শান্ত কণ্ঠঃ মেকসিকোতে এসো না, প্লীজ! মারাত্মক বিপদে পড়বে তাহলে! ক্যালিফোর্নিয়াতেই থাকো…
হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল কণ্ঠটা।
পুরো টেপটা চালিয়ে দেখল কিশোর। আর কোন কথা নেই।
চেয়ারে হেলান দিল সে। মেসেজটা ভাবনায় ফেলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে আরেকটা ব্যাপার খচখচ করছে ওর মনে। কণ্ঠস্বর চেনা চেনা লাগল। আগে শুনেছে। কোথায়, মনে করতে পারল না।
কয়েক মিনিট পরে মুসা এসে হাজির। ওকে টেপটার কথা বলল কিশোর। আবার চালিয়ে দিল ওটা।
কিশোরকে অবাক করে দিয়ে হাসতে লাগল মুসা। কেউ মজা করেছে তোমার সঙ্গে। রসিকতা।
রসিকতা?
হ্যাঁ। কেন, নিজের কণ্ঠস্বর চিনতে পারছ না?
নিজের কণ্ঠস্বর? অবাক হলো কিশোর।
হ্যাঁ, অবিকল তোমার নিজের কণ্ঠ। নকল করেছে কেউ। তুমি যেভাবে অন্যেরটা নকল করো। এ এক মস্ত রসিকতা।
আমার কণ্ঠ!
ইচ্ছে হলে বাজি ধরতে পারো। আমার গাড়িটা ধরতে রাজি আছি আমি।
৩
জানালার কাছে বসেছে কিশোর। পুরানো বাসটা যেন গড়াতে গড়াতে চলেছে মেকসিকোর ভেতর দিয়ে। বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
প্রথমে ভেবেছিল, মুসার গাড়িতে করেই আসবে। কিন্তু পরে বাদ দিতে হলো ইচ্ছেটা, যখন শুনল মেকসিকোতে পেট্রল পাওয়া কঠিন।
নতুন একটা টী-শার্ট পরেছে সে। তাতে বড় বড় করে স্প্যানিশে লেখা রয়েছেঃ হ্যালো, আয়্যাম ফ্রেন্ডলি। সে আশা করছে এতে লোকে তার প্রতি আগ্রহ দেখাবে, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলবে, যে ভাষাটা মোটামুটি বুঝতে পারে সে। বলতেও পারে কিছু কিছু।
শক্ত প্রাস্টিকের সীট। শরীর বাঁকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল সে। অন্য দুজন কি করছে দেখার জন্যে। মেকসিকোর ইতিহাসের ওপর একটা বই পড়ছে রবিন। ওর পাশে বসে আছে অল্প বয়েসী একটা সুন্দরী মেকসিকান মেয়ে। বার বার রবিনের দিকে তাকাচ্ছে। একা চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে মনে হয়। সে চাইছে রবিন পড়া থামিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলুক।
দুটো সীটের মাঝখানে ফাঁক খুব কম। মুসার লম্বা পা ঠিকমত জায়গা হয় না। কোনমতে গুটিয়ে নিয়ে বসেছে, তাতে বেশ অস্বস্তিই লাগার কথা। কিন্তু কেয়ার করছে না যেন সে। ঘুমিয়ে পড়েছে।
ওরা দুজনেও টী-শার্ট পরেছে। মাগনা পেয়েছে রবিন। রক গ্রুপকে এই শার্টই সরবরাহ করেছে ওর কোম্পানি। রবিনেরটায় লেখা দ্য সারভাইভারস ও মুসারটায় লেখা ওয়াইল্ড ওয়েস্ট।
রবিনের পেছনে বসা মাঝারি বয়সের এক মহিলা। বাসের অন্য সব মেকসিকান মহিলা যাত্রীর সঙ্গে কোন তফাৎ নেই ওর। বাদামী চামড়া। সুতীর ব্লাউজ গায়ে দিয়েছে, উলের স্কার্ট। লাল একটা শাল দিয়ে মাথা ঢেকেছে, দুই পাশ ছড়িয়ে আছে দুই কাঁধে। কালো চুলের লম্বা লম্বা দুটো বেণি। সান্তা মনিকায় বাসে ওঠার সময়ই মহিলাকে দেখেছে কিশোর। এর পর দুবার বাস বদল করতে হয়েছে। মহিলা রয়েছে ওদের সঙ্গেই।
অবশেষে বই রেখে পাশের মেয়েটার সঙ্গে কথা আরম্ভ করল রবিন। ইংরেজি জানে মেয়েটা। ফলে কথা বলা সহজ হলো। আমি স্প্যানিশ ভাল বলতে পারি না, বলল সে। এই বুয়েনাস ডায়াস-টায়াস জাতীয় দুএকটা শব্দ।
মেকসিকো কেমন লাগছে? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
মনে হয় ভালই হবে। আগেও যে এখানে এসেছে, সে কথা বলল না রবিন।
এরকম মনে হওয়ার কারণ?
ইয়ে… বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন। ভেবে নিয়ে বলল, আমেরিকায় প্রায়ই মেকসিকান স্ট্রীট মিউজিকের সুনাম শুনি। খুবই নাকি ভাল।
শুধু মিউজিকের জন্যেই? হাসল মেয়েটা। আর কিছু না?